দুর্যোগের প্রকারভেদ

ভূমিকাঃ 

যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বিপন্ন করে তা-ই দুর্যোগ। এডিপিসি অর্থাৎ এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টার এর মতে, দুর্যোগ হচ্ছে প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট ঘটনা, যা হঠাৎ করে ঘটতে পারে অথবা ধীরে ধীরে পরিণত হতে পারে।

উৎপত্তিগতভাবে দুর্যোগ বলতে এমন একটি অবস্থা বুঝায় যা মানুষকে মন্দ বা অকল্যাণকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে। দুর্যোগ বলতে এমন একটি বিপর্যয়কে বুঝায় যা কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের বেশিরভাগ মানুষকে বিপদাপন্ন করে তোলে এবং উক্ত জনগোষ্ঠির তা মোকাবেলা করার ক্ষমতা সাধ্যের বাইরে চলে যায়। এসব দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়। দুর্যোগ কখনো হঠাৎ সংঘটিত হয় আবার কখনো বা এক বা একাধিক ঘটনা ধীরে ধীরে দুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে। আবার অনেক সময় একটি দুর্যোগ একাধিক দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন ভূমিকম্প থেকে সুনামি হতে পারে। আবার সুনামি থেকে জলোচ্ছ্বাস এবং জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা হতে পারে।

দুর্যোগের প্রকারভেদ : 

পৃথিবীব্যাপী যে সকল দুর্যোগ সংঘটিত হয় সেগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ 

খ। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural Disaster): 

প্রাকৃতিক কারণে যে সকল দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে। এ ধরনের দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে ভূমিকম্প / ভূমিধ্বস, সুনামী, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, তুষারপাত, মহামারী, দাবানল ইত্যাদি।

১। ভূমিকম্প বা ভূমি ধ্বস : ভূ-অভ্যন্তরে দীর্ঘ সময়ে পুঞ্জিভূত (accumulated) অতিরিক্ত তাপ, চাপ ও বিক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট শক্তির (Strain) আকস্মিক বিমুক্তির ফলে, অন্য কথায় ভূ-আলোড়নের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের কোন অংশে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকে ভূমিকম্প বলে।

২। বন্যা: পৃথিবীর স্থলভাগ জল দ্বারা প্লাবিত হলে তাকে বলা হয় বন্যা বা বান। বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা:

(ক) মৌসুমী বন্যা 

(খ) আকস্মিক বন্যা

(গ) জোয়ার সৃষ্ট বন্যা।

৩। সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়: ঘূর্ণিঝড় হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি নিম্নচাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরন হয়েছে ঘূর্ণিঝড়।

৪। জলোচ্ছ্বাস: জলোচ্ছ্বাস হলো সমুদ্রের জল ফুলে উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানা। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় বা সুনামির কারণে সমুদ্রের জল সর্বোচ্চ প্রায় ৬৫ মিটার উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে।

৫। সুনামী: সুনামী এক প্রকার জলোচ্ছ্বাস, বস্তুত সুনামীতে পোতাশ্রয়েই সবচেয়ে বেশী ক্ষয়-ক্ষতি হয়। su na: mi / 500-NAH-mee হলো সাগর বা অন্য কোনো জল ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের, ভূমিধ্বসের কিংবা আগ্নেয়গিরির উদ্গীরনের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস বা ঢেউ। সুনামী একটি জাপানী ভাষার শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ পোতাশ্রয় ঢেউ বা harbor wave.

৬। বজ্রপাত : বজ্রপাত বলতে আকাশে আলোর ঝলকানীকে বুঝায়। এই সময় উক্ত এলাকায় বাতাসের প্রসারন এবং সংকোচনের ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে।

খ। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ (Man-made Disaster) : 

মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বলতে মানুষের অবহেলা, ভুলভ্রান্তি বা কোনো বিশেষ অভিপ্রায়ের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগকে বুঝায়। অর্থাৎ এ ধরনের দুর্যোগ মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ, অগ্নিকান্ড, ভবন ধ্বস, পুশইন বা স্থানচ্যুতি, পরিবেশ দুষন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ, রাসায়নিক দূষণ, খাদ্যে কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি মানবসৃষ্ট দুর্যোগের অন্তর্ভুক্ত।

১৯৪৫ সালে আমেরিকা কর্তৃক জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে অসংখ্য মানুষ, সম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা নামে একটি ভবন ধ্বসে পড়ে বহু মানুষ হতাহত হয়। এগুলো মানবসৃষ্ট দুর্যোগের উদাহরণ।

(১) জলাবদ্ধতা : গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা ও চিন্তা নদীর উপর নির্মিত বাঁধের প্রভাব। বালু ভরাট করে নদী সমূহের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দান। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাধার ভরাট করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্ন করা, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। এ সবই মানবসৃষ্ট কারণ যা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।

(২) অগ্নিকান্ড : মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে অগ্নিকান্ড একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা। অগ্নিকান্ড বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। যেমন-বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে, গ্যাসের আগুন, জেনারেটর ব্রাষ্ট, গ্যাস সিলিন্ডার ব্রাষ্ট, ট্রান্সফরমার ব্রাষ্ট, ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে হয়ে থাকে।

(৩) রাসায়নিক দুষণ: পারমানবিক বোমা বিস্ফোরনের মাধ্যমে, বিভিন্ন ধরণের গ্যাস বিস্ফোরনের মাধ্যমে রাসায়নিক দুষন হয়ে থাকে। যার ফলে তাৎক্ষনিকভাবে মানুষ আহত ও নিহত হয় এবং এর প্রভাবে পরবর্তিতে মানুষের অঙ্গপ্রতঙ্গ বিকলাঙ্গ এবং বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।

(৪) যুদ্ধ: বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন জাতিগতভাবে যুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ, পারমানবিক যুদ্ধ,অর্থনৈতিকভাবে যুদ্ধ হয়ে থাকে, যার ফলে দেশের অশান্তির সৃষ্টি হয়।

(৫) ভবন ধ্বস: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। মাটির তলদেশে পর্যাপ্ত পানি রয়েছে বিধায় আমাদের দেশে কোন বহুতল ভবন, শিল্প কারখানা, ঘরবাড়ি, বিল্ডিং নিমার্ণের সময় যদি মেগাসিটির মধ্যে হয় তাহলে সিটি কর্পোরেশন বা রাজউকের এবং জেলা শহরে পৌরসভার অনুমতিক্রমে যথাযথ নিয়ম মেনে বিল্ডিং তৈরী করা। যদি কোন কারণে নিয়ম না মেনে বিল্ডিং তৈরী করা হয় তাহলে কেবল ভবন ধ্বংসের সম্ভাবনা থাকে।

দুর্যোগের ধরণ:

দুর্যোগ দুই ধরনের হতে পারে। যথা- 

ক) ধীর গতিসম্পন্ন দুর্যোগ এবং 

খ) দ্রুত গতিসম্পন্ন দুর্যোগ।

ক। ধীর গতিসম্পন্ন দুর্যোগ (Slow Onset Disaster) : 

ধীর গতিসম্পন্ন দুর্যোগ হলো এমন একটি অবস্থা, যা মানুষের খাদ্য ও জীবিকা নির্বাহের পণ্যসামগ্রী সংগ্রহের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত হয়। যেমন খরা, শস্যহানি, কৃষিক্ষেতে পোকামাকড়ের আক্রমণ ইত্যাদি। এ ধরনের দুর্যোগ সহজেই চিহ্নিত করা যায় বলে তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়।

খ। দ্রুত গতিসম্পন্ন দুর্যোগ (Rapid Disaster) :

এ ধরনের দুর্যোগ আকস্মিক ঘটে থাকে বলে তা সহজে প্রতিরোধ করা যায় না। দ্রুত গতিসম্পন্ন দুর্যোগের ফলে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং জীবন ও সম্পদহানি ঘটে। যেমন-ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি।

উপসংহার: 

দুর্যোগ হলো এমন একটি অস্বাভাবিক অবস্থা যা মানুষের জীবন, সমাজ ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে। দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষকে অনেক কষ্ট করতে হয় এবং স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রকৃতি সৃষ্ট আর মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মনুষ্য সৃষ্ট। মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতে পারে। আর মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর নেতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। যেমন- পানি দূষণ, বায়ু দূষণ। মানুষের বহুমুখী কর্মকাণ্ডই মূলত এসব দূষণের জন্য দায়ী। এর ফলশ্রুতিতে মানবজীবনও মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হয় ।

ক্যাডেট পদোন্নতি পরীক্ষার জন্য দরকারী প্রশ্নাবলি

১। দুর্যোগ কাকে বলে?

২। দুর্যোগ কত প্রকার ও কী কী?

৩। দুর্যোগ কয় ধরণের হয় ও কী কী?

About মুহম্মদ জিয়াউর রহমান

Check Also

বৃক্ষ রোপনের গুরুত্ব

ভূমিকা: বৃক্ষ আমাদের পরমবন্ধু। বৃক্ষ শুধু প্রাকৃতিক শোভাই বর্ধন করেনা, ক্ষয়রোধ করে, বন্যা প্রতিরোধ করে, …

Leave a Reply

Optimized by Optimole