ভূমিকা
ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ প্রবল দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় অবস্থিত একটি দেশ। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের মানুষ সবসময় দুর্যোগ মোকাবেলা করে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে দুর্যোগের তীব্রতা ও প্রকার বহুগুন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতির উন্নতি বা পরিবর্তনের সাথে সাথে দুর্যোগের ঝুঁকি আনুপাতিকভাবে বেড়ে চলেছে। সংগত কারণে মানুষের বেঁচে থাকা এবং ভাল থাকার জন্য আমাদেরকে এই সকল দুর্যোগ ও তার কারণ, প্রকারভেদ এর প্রতিরোধ/প্রতিকার ব্যবস্থা এবং দুর্যোগের পূর্বে ও পরে করণীয় বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা অতীব জরুরী। বিএনসিসি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সদস্যগণ দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্বদানকারী প্রজন্ম হওয়ায় এ বিষয়ে উপযুক্ত ধারণা থাকা এবং তদানুযায়ী যে কোন ক্রান্তীকালে দায়িত্ব পালন করার জন্য এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।
উদ্দেশ্য :
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের লক্ষ্য হবে দেশের স্বীকৃত বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগণকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এমন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যাতে তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে দেশ ও জাতিকে শান্তি ও যুদ্ধকালীন সময় সংগঠিত ও সুশৃঙ্খলভাবে সেবা প্রদানে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের দায়িত্ব ও কর্তব্য :
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের প্রত্যেক তালিকাভূক্ত সদস্য এবং কর্মচারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে নিম্নরূপঃ
ক) দেশের শান্তিকালীন সময় অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসারে এবং নির্ধারিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে সেবা প্রদানের নিমিত্তে প্রস্তুত থাকা।
খ) প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট যে কোন দুর্যোগে দেশ ও বিপন্ন জনগণকে সেবা প্রদান করা।
গ) দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করা।
ঘ) সরকার কর্তৃক অর্পিত অন্য যে কোন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা।
ঙ) বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগের কারণ চিহ্নিত করে দুর্যোগ প্রতিরোধ/ প্রতিকার করার লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগের কারণ, প্রতিরোধ/প্রতিকারঃ
ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
১) ভূমিকম্প বা ভূমিধ্বস :
ভূ-অভ্যন্তরে দীর্ঘ সময়ে পুঞ্জিভূত (accumulated) অতিরিক্ত তাপ, চাপ ও বিক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট শক্তির (Strain) আকস্মিক বিমুক্তির ফলে অন্য কথায় ভূ-আলোড়নের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের কোন অংশে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকে ভূমিকম্প বলে।
ক) ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণ:
ভূমিকম্পের মাত্রা দুইভাবে নির্ধারণ করা যায় যথা:
১. একটি হচ্ছে তীব্রতা (magnitude)
২. অন্যটি প্রচন্ডতা (intensity)
১. তীব্রতা (magnitude)
তীব্রতা রিখটার স্কেলে (ভূকম্পনযন্ত্র) মাপা হয় এবং রিখটার স্কেলে সংখ্যা প্রকাশ করা হয় (১-১০ পর্যন্ত)। ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৫-এর বেশি হলেই বিপদের আশংকা থাকে। তীব্রতা অনুসারে ভূমিকম্পকে নিম্নরূপভাবে শ্রেণীভূক্ত করা যায়;
✓৫ রিখটার স্কেলের নিচে ভূমিকম্পকে ছোট (small),
✓৫-৬ রিখটার স্কেলের নিচের ভূমিকম্পকে মডারেট (moderate),
✓৬-৭ রিখটার স্কেলের নিচের ভূমিকম্পকে ব্যাপক (large scale),
✓৭-৭.৮ রিখটার স্কেলের নিচের ভূমিকম্পকে মেজর (major),
✓৭.৮ বা তার উপরের রিখটার স্কেলের নিচের ভূমিকম্পকে অত্যন্ত ভয়াবহ ।
উল্লেখ্য যে, রিখটার স্কেলের মাত্রা ১ বৃদ্ধি পেলে ভূকম্পনের শক্তি প্রায় ১০ থেকে ৩০ গুণ বেড়ে যায়।
২. প্রচন্ডতা (intensity)
প্রচন্ডতা ক্ষয়-ক্ষতির ব্যাপকতা নির্দেশ করে। এটা সাধারনত সংশোধিত মার্কেলী স্কেলে মাপা হয় এবং রোমান সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। (I-XIII)। ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পর তা মাপা হয় । ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতার দিকে লক্ষ্য রেখে ভূমিকম্পকে নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীভূক্ত করা হয়। যথা:
(ক) ভয়াবহ (Violent)
(খ) প্রচন্ড (Severe )
(গ) মাঝারি (Moderate)
(ঘ ) মৃদু (Mild) ।
খ) ভূমিকম্পের উৎস বা কারণ
ভূমিকম্প বিশারদগণ ভূমিকম্পের বিভিন্ন কারণ নির্ধারণ করেছেন। তার মধ্যে নিম্নোক্তগুলো প্রধান:
(১) অকস্মাৎ ভূ-আন্দোলনজনিত ভূমিকম্প।
(২) আগ্নেয়গিরিজনিত ভূমিকম্প।
(৩) মানবকর্মকান্ডজনিত ভূমিকম্প।
(8) Fault বা ফাঁটল।
(৫) তাপ ও চাপ।
গ) ভূমিকম্প চলাকালীণ সময়ে করণীয়ঃ
(১) ভারী ও শক্ত আসবাবপত্রের (ডেস্ক, টেবিল) নীচে জরুরী আশ্রয় গ্রহণ করা।
(২) ভারী দরজা, কক্ষের কোণ বা শক্তিশালী কোন স্তম্ভের পাশে অবস্থান করা।
(৩) কাঁচের দেয়াল ও কাঁচ দিয়ে তৈরী আসবাবপত্রের পার্শ্বে অবস্থান না করা।
(8) ভূমিকম্পের সময় লিফ্ট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।
ঘ) ভূমিকম্পের প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
(১) বাসস্থান তৈরির সময় গ্যাস ও পানির সংযোগ স্থাপনে নমনীয় পাইপ ফিটিংস ব্যবহার করা।
(২) ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ঝুলন্ত বা ঝাঁড়বাতি ব্যবহার পরিহার করা।
(৩) বাসস্থানের প্রতিটি কক্ষে একটি নিরাপদ স্থান জরুরী আশ্রয়ের জন্য নির্ধারণ করা।
(৪) ঘরের ব্যবহার্য ভারী আসবাবপত্র (তাক, আলমারী, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি) দেয়ালের সাথে সংযুক্ত করে রাখা।
(৫) ভারী সামগ্রী (কাঁচের তৈজসপত্র) অপেক্ষাকৃত নীচের তাঁকে সংরক্ষণ করা।
২। বন্যাঃ পৃথিবীর স্থলভাগ জল দ্বারা প্লাবিত হলে তাকে বলা হয় বন্যা বা বান। বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে ৩ শ্রেনীতে ভাগ করা হয়ঃ
ক. মৌসুমী বন্যা
খ. আকস্মিক বন্যা
গ. জোয়ার সৃষ্ট বন্যা।
ক) বন্যা সংঘটনের কারণ
নিম্ন উচ্চতা বিশিষ্ট ভূ-সংস্থান, ভারী বৃষ্টিপাত, হিমালয়ের তুষার গলন এবং হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন, পলি জমাটের ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হওয়া ইত্যাদি।
খ) বন্যার সময় করনীয়ঃ
(১) হঠাৎ বন্যার পানি বৃদ্ধি পেলে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ।
(২) বন্যার প্রবাহিত জলে গাড়ি চালানো পরিহার করা।
(৩) বন্যার প্রবাহিত জলে চলাফেরা হতে বিরত থাকা
(৪) বন্যার পানি পান না করা।
(৫) গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বস্তু ও কাগজপত্র উঁচু স্থানে সংরক্ষণ করা।
গ) বন্যা প্রতিরোধের উপায়ঃ
(১) প্লাবনভূমিতে, বিশেষত ভারী বৃষ্টিপাতের সময় বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ দালান তৈরী করা এড়িয়ে চলা।
(২) বাড়িতে বন্যার জলের প্রবেশ বন্ধ করতে বাধা তৈরি ও লেভীসবীম, ফ্লাডওল তৈরী করণ।
(৩) স্যান্ডব্যাগ গুলি জরুরী পরিস্থিতিতে একটি অস্থায়ী বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে।
(৪) আবহাওয়ার পূর্বাভাসের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। যখন ভারী বৃষ্টি বা ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়, বন্যার ঝুঁকির বিষয়ের তথ্যের জন্য রেডিও বা টেলিভিশন শুনা আবশ্যক।
৩। সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় :
ঘূর্ণিঝড় হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বজ্ৰ ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি নিম্নচাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরন হয়েছে ঘূর্ণিঝড়।
ক) ঘূর্ণিঝড়ের কারণ:
কোন এলাকায় বাতাস অত্যন্ত উত্তপ্ত হলে সে এলাকার বায়ুভর যা নিম্ন বায়ুমন্ডলীর চাপের প্রভাবে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে যার ফলে ঘূর্ণি ঝড়ের সৃষ্টি হয়।
খ) ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধের উপায়:
(১) ঘূর্ণিঝড় পরিকল্পনা এবং জরুরী কিট পরীক্ষা করা।
(২) বিদ্যুতের সমস্যা এবং মোবাইল নেট ওয়ার্কগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আপনার জরুরী কিটের অংশ হিসেবে আপনার কাছে ব্যাটারী চালিত রেডিও রয়েছে তা নিশ্চিত করা।
(৩) আবহাওয়ার পূর্বাভাসের প্রতি মনোযোগ দেয়া। যখন ভারী বৃষ্টি বা ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়, বন্যার ঝুঁকির বিষয়ের তথ্যের জন্য রেডিও বা টেলিভিশন শুনা জরুরী।
৪। জলোচ্ছ্বাস:
জলোচ্ছ্বাস হলো সমুদ্রের জল ফুলে উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানা। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় বা সুনামির কারণে সমুদ্রের জল সর্বোচ্চ প্রায় ৬৫ মিটার উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
৫। সুনামী:
সুনামী এক প্রকার জলোচ্ছ্বাস, বস্তুত সুনামীতে পোতাশ্রয়েই সবচেয়ে বেশী ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
Tsunami / 500-NAH-mee হলো সাগর বা অন্য কোনো জল ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের ভূমিধ্বসের কিংবা আগ্নেয়গিরির উদগীরনের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস বা ঢেউ। সুনামী একটি জাপানী ভাষার শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ পোতাশ্রয় ঢেউ বা harbor wave.
সুনামীর সময় করণীয়ঃ
(১) উপকূলবর্তী অঞ্চলে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করা ।
(২) উপকূলবর্তী অঞ্চলে পাখিদের অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করা।
(৩) সুনামির সময় অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে অবস্থান করা।
(৪) শক্তিশালী ভবনের উচ্চ কক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করা।
৬। বজ্রপাত
বজ্রপাত বলতে আকাশে আলোর ঝলকানীকে বুঝায়। এই সময় উক্ত এলাকায় বাতাসের প্রসারন এবং সংকোচনের ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে।
(ক) বজ্রপাত এর সময় করণীয় :
(১) ভারী বর্ষণ এবং বৃষ্টিপাতের সময় বজ্রপাত হয়। এ সময় আমাদের কাজ হচ্ছে ঘর থেকে বাহির না হওয়া।
(২) যথাসম্ভব টিনের চালের নীচে বা গাছের নীচে না থাকা।
(৩) দালান কোঠা অথবা নিরাপদ হবে এমন স্থানে থাকা।
(8) খোলা স্থানে থাকা অবস্থায় বজ্রপাত হলে সাথে সাথে মাটিতে শুয়ে পড়া।
(খ) বজ্রপাত প্রতিরোধের উপায়ঃ
(১) বজ্রপাত প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত লম্বা হয় জাতীয় গাছ লাগানো।
(২) বেশী বেশী তালগাছ লাগানো।
(৩) প্রত্যেক বিল্ডিং, স্থাপনা, কলকারখানা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সময় উপরে থান্ডার এ্যারিষ্টার লাগাতে হবে।
খ। মানব সৃষ্ট দুর্যোগ :
মানব সৃষ্ট দুর্যোগ বলতে মানব কর্মকান্ডের ফলে সংঘটিত দুর্যোগসমূহকে বুঝায়। যেমনঃ জলাবদ্ধতা, অগ্নিকান্ড, রাসায়নিক দুষণ, যুদ্ধ ইত্যাদি।
(১) জলাবদ্ধতা ও তার কারণ
গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা ও তিস্তা নদীর উপর নির্মিত বাধের প্রভাব। বালু বরাট করে নদীসমূহের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দান। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাধার ভরাট করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্ন করা, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
জলাবদ্ধতা প্রতিরোধের উপায়ঃ
(১) নদীর নাব্যতা চলমান রাখা ।
(২) খালবিল ভরাট করে কলকারখানা তৈরী না করা।
৩) পানি প্রবাহের স্থানে খাল বা ড্রেনের উপর কোন প্রকার স্থাপনা না করা।
২) অগ্নিকান্ড ও তার কারণ :
মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে অগ্নিকান্ড একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা। অগ্নিকান্ড বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে । যেমন-বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে গ্যাসের আগুন, জেনারেটর ব্রাষ্ট,গ্যাস সিলিন্ডার ব্রাষ্ট টান্সফরমার ব্রাষ্ট, ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে হয়ে থাকে।
অগ্নিকান্ড প্রতিরোধের উপায় :
অগ্নিকান্ড প্রতিরোধের উপায়গুলো হচ্ছে :
(১) ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করা।
(২) গ্যাস বা বাতাস প্রবাহ বন্ধ করা।
(৩) তাপনিয়ন্ত্রণ করা, জ্বালানির উৎস বন্ধ করা।
(৪) প্রতিটি স্থাপনা এবং শিল্প কলকারখানায় পরিমিত আগুন নির্বাপনের সামগ্রী (ফায়ার এক্সটিংগুইসার, বালি, পানি, ফায়ার হুক, বেলচা) ইত্যাদি রাখা।
৩) রাসায়নিক দুষণ:
পারমানবিক বোমা বিস্ফোরনের মাধ্যমে, বিভিন্ন ধরণের গ্যাস বিস্ফোরনের মাধ্যমে রাসায়নিক দুষন হয়ে থাকে। যার ফলে তাৎক্ষনিকভাবে মানুষ আহত ও নিহত হয় এবং এর প্রভাবে পরবর্তিতে মানুষের অঙ্গপ্রতঙ্গ বিকলাঙ্গ এবং বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
রাসায়নিক দুষণের কারণ:
(১) রাসায়নিক পদার্থ সঠিক ভাবে সংরক্ষণ না করা।
(২) গ্রীণ হাউজ গ্যাস নির্গমণের কারণে।
(৩) পারমানবিক বিস্ফোরনের কারণে।
রাসায়নিক দুষণের প্রতিকার:
(১) রাসায়নিক পদার্থ সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা।
(২) পারমানবিক বিস্ফোরন ঘটানো সীমিত রাখা।
(৩) রাসায়নিক পদার্থ যত্রতত্র ব্যবহার না করা।
(8) যুদ্ধ:
বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন-জাতিগতভাবে যুদ্ধ, মনস্তাত্বিক যুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ, পারমানবিক যুদ্ধ, অর্থনৈতিকভাবে যুদ্ধ হয়ে থাকে, যার ফলে দেশের অশান্তির সৃষ্টি হয়।
যুদ্ধের কারণ:
(১) ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে যুদ্ধ।
(২) সীমান নির্ধারণের জন্য যুদ্ধ।
(৩) অর্থনৈতিক প্রভাবের জন্য যুদ্ধ।
(৪) জাতিগত যুদ্ধ।
(৫) ধর্মীয় উস্কানির মাধ্যমে যুদ্ধ।
যুদ্ধের প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
(১) সীমানা প্রাচীর নির্ধারণ করে যুদ্ধের প্রতিরোধ করা।
(২) শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে।
(৩) শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে।
(৪) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক।
(৫) ভবন ধ্বস :
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। মাটির তলদেশে পর্যাপ্ত পানি রয়েছে বিধায় আমাদের দেশে কোন বহুতল ভবন, শিল্প কারখানা, ঘরবাড়ি, বিল্ডিং নিমার্ণের সময় যদি মেগাসিটির মধ্যে হয় তাহলে সিটি কর্পোরেশন বা রাজউকের এবং জেলা শহরে পৌরসভার অনুমতিক্রমে
যথাযথ নিয়ম মেনে বিল্ডিং তৈরী করা। যদি কোন কারণে নিয়ম না মেনে বিল্ডিং তৈরী করা হয় তাহলে কেবল ভবন ধ্বসের সম্ভাবনা থাকে।
ভবন ধ্বংসের কারণ:
(১) যথাযথ নিয়ম না মেনে ভবন তৈরী করা।
(২) প্রয়োজনের চেয়ে কম এবং নিম্নমানের জিনিসপত্র দিয়ে ভবন তৈরী করা।
(৩) যে স্থানে দুতলা ভবন তৈরী করতে পারবে সে স্থানে পাঁচতলা ভবন তৈরী করা।
(৪) মাটির নীচে শক্তভাবে বেইজ বা পাইলিং না করে বিল্ডিং তৈরী করা ।
ভবন ধ্বংসের প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
(১) ভবন তৈরী করার পূর্বে রাজউকের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ড্রয়িং করা। (২) মানসম্মত জিনিসপত্র দিয়ে ভবন তৈরী করা।
(৩) ড্রয়িং এর প্রস্তাবনার বাহিরে কাজ না করা।
(৪) মাটির নীচে শক্তভাবে বেইজ বা পাইলিং করা ।
বিভিন্ন দুর্যোগের পূর্বে এবং পরে বিএনসিসি ক্যাডেটদের প্রস্তুতি ও করণীয়:
বাংলাদেশে যে কোন সময় প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হতে পারে বিধায় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সদস্য হিসেবে আমাদেরকে সবসময় প্রস্তুত থাকা আবশ্যক। তার জন্য চাই সময়োপযোগী ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আধুনিক সরঞ্জামাদী । দুর্যোগ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে মোকাবেলা করার জন্য বিএনসিসি ক্যাডেটদের স্ব স্ব রেজিমেন্ট এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ ও নির্দেশ ক্রমে বিভিন্ন বাহিনীর সাথে সমন্বয় সাধন করে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে।
দুর্যোগ মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপ:
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। প্রায় প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, কালবৈশাখী, নদীভাঙন, খরার মতো কোনো না কোনো দুর্যোগে আক্রান্ত হয়। এসব দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে সরকার যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তা বাংলাদেশকে একটি দক্ষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন দেশে পরিণত করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দেশের আপামর জনগণের দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যে কোনো প্রলয়ংকরী দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি জরুরি সাড়া প্রদান পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।
খ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দুর্যোগ সংক্রান্ত কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, গবেষণা কর্ম পরিচালনা, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ পূর্ব প্রস্তুতি এবং মোকাবেলায় কাজ করে থাকে।
গ। জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ ও সমন্বয়:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল, আমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি এবং জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে।
ঘ। স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি:
স্থানীয়ভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপত্রের লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির মধ্যে রয়েছে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, ইউনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রভৃতি। এসব কমিটি দুর্যোগ পূর্ববর্তী এবং দুর্ভেগ পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
ঙ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ের উপর অনার্স, মাস্টার্স এবং ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছে। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
চ। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF) :
সরকার ২০১০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড আইন কার্যকর করে এবং এর আগে ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড নীতিমালা তৈরি করে। এই ট্রাস্টের আওতায় অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমন এবং স্থানচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম।
ছ। প্রশিক্ষণ :
সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণকে | প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। যেমন- বাংলাদেশ পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি, কারারক্ষী, বিএনসিসির সদস্যদের দুর্যোগকালীন দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ প্রদান। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন এনজিওর সহযোগিতায় জেলায় জেলায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে।
জ। সতর্কীকরণ বার্তা প্রচার :
দুর্যোগ পূর্ববর্তী সতর্কীকরণের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দুর্যোগ বার্তা প্রচার, এসএমএস, ইন্টারেকটিভ ভয়েস রেসপন্স, কমিউনিটি রেডিও, উপকূলীয় অঞ্চলে পকেট রেডিও ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
ঝ। মাইক্রোজোনেশন মানচিত্র :
আইসিটি নির্ভর মাইক্রোজোনেশন মানচিত্র তৈরি করা। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরের এরূপ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে যা ভূমিকম্প ঝুঁকিমুক্ত নগরায়নের কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আরো ৬টি ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মাইক্রোজোনেশন মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়েছে।
ঞ। বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের পাশপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে।
অক্সফাম, ডিজাস্টার ফোরাম কেয়ার বাংলাদেশ, প্রশিকা, সিসিডিবি, বাংলাদেশ দুর্যোগ প্রস্তুতি কেন্দ্র প্রভৃতি সংস্থা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ প্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে।
ট। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আইন ও নীতিমালা:
সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে কার্যকরভাবে নিশ্চিতকরণ এবং দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনের লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১১। এছাড়া ১৯৯৭ সালের দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী সংশোধন করে ২০১০ সালে স্টান্ডিং অডার্স অন ডিজাস্টার্স (এসওডি) সংশোধন করা হয়।
ঠ। অবকাঠামোগত পদক্ষেপ:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যেসব অবকাঠামোগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো:
(১) দুর্যোগকালীন সময়ে সকলের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করার জন্য
(২) উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারা দেশে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ। যেমন-উপকূলীয় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। সবুজ বেষ্টনি প্রকল্প, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি।
(৩) বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, সুইস গেট, নদী ও খাল খনন।
(৪) নদীভাঙন রোধের জন্য নদীর পাড় বাঁধাই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।
(৫) ভূমিকম্প সহনশীল ঘরবাড়ি, ব্রীজসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ।
(৬) বিভিন্ন দুর্যোগে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় প্রভৃতি।
উপসংহারঃ
যেহেতু বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর একটি স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী। তাই আমাদের মূল কাজ হলো স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে আমাদেরকে সব সময় তৈরী থাকা। বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য দুর্যোগের আগে, দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগের পরে দেশের জাতীয় কমিটিসহ বিভিন্ন বাহিনীর সাথে সমন্বয় রেখে কাজ করে যাওয়া। পরিশেষে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দুর্যোগপূর্ণ দেশ হিসেবে সবসময় আমাদের দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকা।