বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী

ভূমিকা

আল্লাহ পাকের সৃষ্টি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও বিশ্ব জাহানে উম্মতি মুহাম্মদিদের একমাত্র মুক্তির দূত আখেরী নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী এ পর্যায়ে আলোচন করা হলো। নিম্নে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কার্যক্রম ও ঘটনাসমূহ বিবৃত হলো:

জন্ম ও শৈশব

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আরব দেশের মক্কা নগরে কুরাইশ গোত্রের বনী হাশিম বংশে ৫৭০ খৃঃ ১২ই রবিউল আওয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল্লাহ তাঁর জন্মের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন এবং মাতা আমিনা তাঁর জন্মের ৬ বছর পরে মৃত্যু বরণ করলে তিনি পিতা-মাতা হারিয়ে এতিম হন। পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা আব্দুল মোত্তালিব এর কাছে প্রতিপালিত হওয়ার ৮ বছর পর তাঁর দাদা ইন্তেকাল করেন। এরপর শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন চাচা আবু তালেব। তৎকালীন আরবের রীতি অনুযায়ী মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় সন্তান বেড়ে উঠার মাধ্যমে তাদের সুস্থ্য দেহ ও সুঠাম গঠনের জন্য মরুভূমির বেদুইন মহিলাদের কাছে দুধ পান করানোর জন্য দিয়ে দিতেন এবং পরে আবার ফিরে নিতেন। এই রীতি অনুযায়ী শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) কে দুধ মা হালিমার নিকট দিয়ে দেয়া হয়। তাঁকে ঘরে আনার পর মা হালিমার সংসারে অধিক উন্নতি সাধিত হয়। তিনি মা হালিমার একটি স্তন পান করতেন এবং অপরটি তার দুধ ভাই এর জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর প্রতিপালনের পর তাঁকে মা আমিনার নিকট ফিরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় মক্কায় মহামারির কারণে আবার তাঁকে দুধ মা হালিমার নিকট পাঠানো হয়। দুধ মা হালিমা অবশ্য এটাই মনে মনে কামনা করছিলেন।

এই ঘটনার পরেই দুধ মা হালিমা তাঁকে মা আমিনার নিকট ফিরিয়ে দেন। এভাবে ৬ বছর পর্যন্ত মা আমিনার কাছেই তিনি প্রতিপালিত হন। এই সময় মা আমিনা স্বামীর কবর জিয়ারত ও নিজ আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তাঁর শশুর আব্দুল মোত্তালিব, শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) ও দাসী আয়মনকে সংগে নিয়ে ৫০০ কিঃ মিঃ পথ পাড়ি দিয়ে মক্কা হতে মদীনায় গমন করেন। মদীনায় একমাস থাকার পর মক্কায় ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে এসে মা আমিনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মা আমিনার ইন্তেকালের পর দাদা আব্দুল মোত্তালিব তাঁকে লালন পালন করেন। কিছুদিন পর দাদার ইন্তেকালের পর চাচা আবু তালেব এঁকে প্রতিপালন করেন। চাচা আবু তালেব ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। আরবদেশের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তিনি ব্যবসার কাজে বছরে একবার সিরিয়া গমনাগমন করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যবসায়ী চাচা আবু তালেবের সাথে মুহাম্মদ (সাঃ) সিরিয়া গমন করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর।

হিলফুল ফুজুল গঠন

আরবদের মধ্যে রক্তপাত, হিংসা হানাহানী, ঝগড়া-বিবাদ সব সময় লেগেই থাকতো। মুহাম্মদ (সাঃ) এই অবস্থা দুর করার জন্য হিলফুল ফুজুল নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন। ইহার মাধ্যমে মক্কায় কিছুটা হলেও শান্তি ফিরে আসে। এই সংগঠনটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

পেশা

অনেকের মতে, তরুণ বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ) এর কোন পেশা ছিল না, তবে তিনি বকরী চড়াতেন বলে জানা যায়। তিনি যে বকরী চড়াতেন তা ছিল বনী সাদ গোত্রের। এর পর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। এতে তিনি অধিক সততার পরিচয় দেন বলে তাকে সবাই আল সাদিক ও আল আমিন আখ্যা দিয়েছিল; যার বাংলা অর্থ- সত্যবাদী ও বিশ্বস্থ ব্যবসা উপলক্ষ্যে তিনি বসরা, বাহরাইন ও ইয়েমেন সফর করেন। তাঁর ব্যবসার অগ্রগতি দেখে খাদিজা (রাঃ) তার কিছু পণ্য দিয়ে বসরা পাঠান। পরবর্তিতে খাদিজা (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালে তিনি চাচা আবু তালেবের সাথে পরামর্শ করে উত্তর জানান। এর পর উভয়ের বিবাহ কার্য সুসম্পন্ন হয়। তখন খাদিজা (রাঃ) এর বয়স ৪০ বছর এবং মোহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স মাত্র ২৫ বছর।

কাবাঘর সংস্কার 

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন তিনি কাবাঘর সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পুরাতন কাবাঘরটি ভেঙ্গে নতুন কাবাঘর তৈরীর কাজ শেষ হওয়ার পর হাজরে আসওয়াদ পাথর বসানো নিয়ে পরস্পর গোত্রদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিরোধটি এমন এক পর্যায় রূপ নেয় যে, শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধার উপক্রম হয়। কাবাঘর তৈরীর কাজ সকল গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া ছিল; কিন্তু হাজরে আসওয়াদ পাথর বসানোর কাজ কোন গোত্রকে দেয়া হয়নি বলে উহা সকল গোত্রের লোকেরা বসানোর জন্য দাবী করে। অবশেষে আবু উমাইয়া মকজুমী এই মতামত দেন যে, আগামী কাল ভোরে যে প্রথম কাবাঘরে প্রবেশ করবে তাঁর সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নিবে। পরের দিন ভোরে সর্বপ্রথম কাবাঘরে প্রবেশ করেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। আবু উমাইয়া মকজুমীর প্রস্তাব অনুযায়ী মুহাম্মদ (সাঃ) হলেন সিদ্ধান্ত দানকারী। তিনি এই সিদ্ধান্ত দিলেন যে, একটি চাদরের উপর হাজরে আসওয়াদ পাথরটি রেখে উক্ত চাদরের কোনায় গোত্রদের প্রধানগণ ধরে কাবাঘরের কাছে নিয়ে যাবে। এরপর উক্ত পাথরটি মুহাম্মদ (সাঃ) কাবাঘরের দেয়ালে স্থাপন করবেন। এই কাজটি করার ফলে কারো মধ্যে আর কোন বিরোধ রইল না এবং সকলেই সন্তুষ্ট হলো।

নবুয়ত প্রাপ্তী 

৩০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর হতে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান মগ্ন অবস্থায় আল্লাহর এবাদত করতেন। এ সময় খাদিজা (রাঃ) তাঁর খাবার দিয়ে আসতেন। এমনই ধ্যান মগ্ন অবস্থায় একদিন ফেরেস্তা জিবরাইল (আঃ) আল্লাহ পাকের কালাম নিয়ে হাজির হন। জিবরাইল (আঃ) উক্ত কালাম পাঠ করতে বললে নবীজি (সাঃ) তা পড়তে পারেন না বলে জানান। তারপর জিবরাইল (আঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলে তিনি পাঠ করতে পারেন না বলে আবারও জানান। এইভাবে তিনবার জিবরাইল ফেরেস্তা তার বুকের সাথে চাপ দিয়ে ধরার ফলে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) উক্ত আয়াতটি পড়তে শুরু করেন।

সুরা আলাকের প্রথম হতে পাঁচ আয়াত পর্যন্ত সর্বপ্রথম মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর নাজিল হয়। যার বাংলা অর্থ হলো- “পড়তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি কলবের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। এই প্রথম ফেরেস্তা জিবরাইল (আঃ) এর আগমনে তিনি এতটাই ভীত হন যে, কাঁপতে কাঁপতে স্ত্রী খাদিজার (রাঃ) এর নিকট এসে তাঁকে কম্বল দিয়ে আবৃত করার কথা বলেন। ৪০ বছর বয়সে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্ত হন। এই সময় হতে নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর নিয়মিত ভাবে ওহী আসতে থাকে। এভাবেই জীবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর পূর্ণ ৩০ পাড়া কোরান শরীফ নাজিল হয়।

ইসলাম প্রচার

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ইসলামকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। তৎকালীন বরাবর আরবদের মাঝে ইসলাম প্রচার করা তথ্য ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। ঐ সময় আরবের বিধর্মীরা ছিল প্রভাবশালী। তারা বিভিন্ন দেব-দেবী ও মুর্তি পূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের চিরাচরিত এই বিশ্বাসের ভীত ভেঙ্গে ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করা খুবই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। তারপরও তিনি বসে না থেকে পূর্ণদ্যমে ইসলাম প্রচারের কাজ চালিয়ে যান। প্রথমে তিনি নিজ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন তার স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)। পরবর্তীতে তাঁরই গৃহে প্রতিপালিত তাঁর চাচাত ভাই হযরত আলী (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন হযরত আলীর বয়স মাত্র ১০ বছর। ইসলামকে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি প্রথমে তার নিজ বংশের লোকদের নিয়ে একটি সভা করেন। কিন্তু কেউই তার এই দাওয়াত কবুল করে নাই। এই সভায় শুধুমাত্র একজনই ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)। এভাবে তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচারের পর তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। প্রথমেই তিনি সাফা পাহাড়ে দাড়িয়ে প্রকাশ্যে সবাইকে সমবেত করে ইসলাম গ্রহণে আহ্বান করেন। এর পর হতেই ইসলামের শত্রু বাড়তে থাকে। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা যখন চরম আকার ধারণ করে তখন নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কিছু সাহাবাকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে অনুমতি প্রদান করেন। ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে চরম শত্রু ছিল তারই চাচা আবু জেহেল ও ওমর। নবীজি (সাঃ) সব সময় চাইতেন তারা যেন ইসলাম গ্রহণ করেন। কিছু দিনের মধ্যে হযরত ওমর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে নবীজি (সাঃ) এর পক্ষ্যে ইসলাম প্রচার করা সহজ হয়। এরপর নবীজি (সাঃ) এর চাচা আমির হামজা ইসলাম গ্রহণ করার ফলে ইসলাম প্রচার আরো গতিশীল হয়। এইভাবে ইসলাম প্রচার চলতে থাকার এক পর্যায়ে মক্কার প্রভাবশালী কুরাইশরা নবীজি (সাঃ) সহ বনী হাশিম গোত্রের লোকদেরকে তিন বছর একঘরে করে রাখে। তিন বছর অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্ত হওয়ার পরের বছরেই নবীজি (সাঃ) এর স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) ও চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করলে নবীজি (সাঃ) ইসলাম প্রচারে ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পরেন।

তাই তিনি মক্কায় ইসলাম প্রচার স্থগিত রেখে তায়েফ গমন করেন। নবীজি (সাঃ) তায়েফে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করলে তায়েফবাসী না বুঝে তাঁকে চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্চিত করে। সেখানকার কিশোর ও যুবকদের লেলিয়ে দিয়ে নবীজি (সাঃ) এর উপর ইট পাটকেল মেড়ে রক্তাক্ত করে দেয়। নবীজি (সাঃ) এর শরীরের রক্ত গড়িয়ে পায়ের জুতার মধ্যে প্রবেশ করে, এতে নবীজি (সাঃ) এর পদযুগল জুতার মধ্যে আটকে যায়।

তায়েফ বাসীর এহেন আচরণে নবীজি (সাঃ) তাদের উপর কোন প্রকার অভিশাপ কিদা গাল মন্দ করেন নাই। এত কষ্ট পাওয়ার পরও নবীজি (সাঃ) ইসলাম প্রচার বন্ধ করেন। নাই বরং নতুন করে ভাবতে থাকেন কোথায় কিভাবে ইসলাম প্রচার করা যায়।

ইসরা ও মেরাজ 

এক রাতে মক্কার মসজিদুল হারাম হতে বোৱাক নামক এক প্রকার বাহনের মাধ্যমে নারী | মুহাম্মদ (সাঃ) কে জেরুযালেমের মসজিদুল আকসা নিয়ে যাওয়া হয়। এই ভ্রমণ ইতিহাসে ইসরা নামে পরিচিত। মসজিদুল আকসায় নবী মোহাম্মদ (সাঃ) নবীগণের সাথে পরিচিত হন এবং সেখানে তিনি জামাতে নামাজ আদায়ের সময় ইমামতি করেন। এরপর বিশেষ বাহনের মাধ্যমে নবীজি (সাঃ) কে উর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ভ্রমণ ইতিহাসে মেরাজ নামে অভিহিত হয়। মেরাজের মাধ্যমে নবীজি (সাঃ) আল্লাহ পাকের পরম সান্নিধ্য লাভ করেন। তার পর তিনি একে একে বেহেস্ত-দোজখসহ আল্লাহ, পাকের সৃষ্টি জগতের সকল কিছুই অবলোকন করেন। মেরাজ চলাকালীন সময়ে পৃথিবীতে কোন সময় অতিবাহিত হয় নাই।

মদীনায় হিযরত

।,র্য?একদিকে মক্কার কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা ক্রমাগতভাবে বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত নবীজি (সাঃ) এর জীবন নাশের পর্যায় চলে আসে। অপর দিকে মদীনায় আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় দীর্ঘদিন যাবৎ গোত্র ভিত্তিক জন্ম কলহ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সব সময়ই লিপ্ত থাকতো। এই অবস্থা হতে তারা নিজেরাই পরিত্রান পাওয়ার জন্য কোন এক তৃতীয় নেতৃত্বের সহযোগীতা কামনা করছিল। বিশেষ করে তারা নবীজি (সাঃ) এর মদীনায় আগমনের প্রত্যাশা করছিল। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে নবীজি মুহাম্মদ (সাঃ) ৬২২ খ্রীঃ এক রাতে একান্ত বিশ্বস্থ ব্যক্তি হযরত আবু বকরকে সংগে নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এর মাধ্যমেই নবীজি (সাঃ) এর মক্কা জীবনের অবসান ও মদীনার জীবন শুরু হয়। নবীজি (সাঃ) মদীনায় বিবাদমান সকল গোত্রের লোকদেরকে একত্রিত করেন এবং সকল বিবাদ ভুলে তারা ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নবীজি (সাঃ) মদীনা বাসীদের নিয়ে একটি মদীনা রাষ্ট্র গঠন করেন। মদীনা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মদীনা সনদ নামে একটি দলিল তৈরী করেন এবং তাতে সকলেই স্বাক্ষর করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ইহাই প্রথম সংবিধান। নবীজি (সাঃ) মদীনা রাষ্ট্রের প্রশাসক হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন মক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্র ধ্বংস করার জন্য বারবার চেষ্টা করে, কিন্তু নবীজি (সাঃ) এর দুরদর্শিতায় তা ব্যর্থ হয়। ৬২৪ খৃঃ বদর নামক স্থানে মক্কার কুরাইশ বাহিনীর সাথে নবীজি (সাঃ) অনুগত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন। ৬২৫ খৃঃ উহুদের যুদ্ধে। নবীজি (সাঃ) এর সৈন্য দল বিজয় লাভ করে। ৬২৭ খৃঃ আবু সুফিয়ান একদল সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমন করার জন্য অগ্রসর হলে খন্দক নামক স্থানে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধেও নবীজি (সাঃ) এর সৈন্যদল বিজয় লাভ করে। ক্রমাগতভাবে নবীজি (সাঃ) এর বিজয়ের ফলে মুসলমানরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে মদীনার ভেতর হতে ইহুদীদের বের করে দিয়ে মদীনার আশে পাশের এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন। এতে নিরাপদ মদীনা কায়েম হয়।

হিযরী সাল গণনা

নবী মুহাম্মদ (স:) এর মদীনায় হিযরতের বছর হতে একটি আরবী সাল গণনা করা হয়। ইহাকে বলা হয়Ah বা আফটার অফ হিযর অর্থাৎ হিযরতের পর। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর(রা:) এর শাসনামলে হিযরতের সতের বছর থেকে এ সনটির প্রচলন করা হয়। এই ভাবে অধ্যাবধি হিযরী সর প্রচলিত রয়েছে।  

হজ্বব্রত পালন  

পবিত্র কোরান শরীফে হজ্ব পালনের কথা উল্লেখ থাকলেও মক্কার কুরাইশদের কারণে মুসলমানরা হজ্ব পালন করতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে একদিন নবীজি (সাঃ) দিবাদর্শনে হজ্ব পালন করার জন্য মাথা কামানো দেখতে পান। এ কারণেই তিনি হয়। পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৬ হিযরি সনের শাওয়াল মাসে ১৪ শত সাহাবী নিয়ে নবীজি (সাঃ) মদীনা হতে মক্কায় হজ্ব পালনের জন্য রওয়ানা হন। এতে কুরাইশরা বাধা প্রদান করলে নবীজি (সাঃ) মক্কার অদুরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানে জিলকদ মাসে মুসলমানদের সাথে কুরাইশদের একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। এই সন্ধির শর্তানুযায়ী নবীজি (সাঃ) সে বছর লোকজন নিয়ে হজ্ব না করেই মদীনায় ফিরে যান। যদিও এই সন্ধির অনেক শর্তই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছিল তথাপিও ভবিষ্যৎ কল্যাণের আশায় নবীজি (সাঃ) তা মেনে নেন।

বহির্বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত

নবী মুহম্মদ (সাঃ) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব এবং বিশ্ব জাহানের একমাত্র পথপ্রদর্শক ও বিশ্ব মানবতার কান্ডারী। তাই নবীজি (সাঃ) শুধু মাত্র মক্কায় ইসলাম প্রচার করেই বসে থাকেন নাই বরং বহির্বিশ্বেও ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। তিনি সরস্য, রোম ও আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত প্রেরণ করেন। যার ফলশ্রুতিতে আজ ইসলাম সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

মক্কা বিজয়

হুদাইবিয়ার সন্ধি ১০ বছর মেয়াদি হলেও তা ২ বছর পরই ভেঙ্গে যায়। আরবের জোয়া গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র অপর দিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের মিত্র। এক রাতে খোজায়া গোত্রের উপর বকর গোত্র হামলা চালায়। এই হামলায় কুরাইশরা বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। এমনকি কুরাইশদের কিছু যুবকও এই হামলায় অংশ গ্রহণ করে। এই ঘটনায় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ একটি পত্র প্রেরণ করেন। নবীজি (সাঃ) কুরাইশদেরকে উক্ত পত্রের তিনটি শর্তের মধ্যে যে কোন একটি শর্ত মেনে নিতে বলেন।

হতে শর্ত তিনটি ছিল – 

(১) কুরাইশরা খোজায়া গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করবে। অথবা 

(২) তারা বকর গোত্রের সাথে তাদের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করবে। অথবা 

(৩) তারা এ ঘোষণা দিবে যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে এবং কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কুরাইশরা তৃতীয় শর্তটি মানার কথা জানায়। কিন্তু পরবর্তিতে কুরাইশগণ তাদের সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার বিষয়টি উপলব্দি করে তারা আবার আবু সুফিয়ানকে চুক্তি নবায়ন করার জন্য মদীনায় পাঠান। কুরাইশদের এই প্রস্তাব নবীজি (সাঃ) প্রত্যাখ্যান করেন এবং মক্কা আক্রমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৬৩০ খৃঃ নবীজি (সাঃ) ১০ হাজার সাহাবী নিয়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। দিনটি ছিল ৮ম হিযরীর রমজান মাসের ১০ তারিখ। মোটামুটি বলা যায় বিনা প্রতিরোধেই মক্কা বিজয় সংগঠিত হয়। মক্কা নগরের ১০ জন ব্যতিত সবাইকে নবীজি (সাঃ) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। পরে ঐ ১০ জনের মধ্যে আরও কয়েকজনকে ক্ষমা করেন। বাকীদের ক্ষমা না করার কারন হলো, তারা নবীজি (সাঃ) এর সম্পর্কে কুৎসা রটাচ্ছিল। মক্কা বিজয় করে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথমেই কাবা গৃহে প্রবেশ করে কাবা গৃহের সকল মূর্তি অপসারণ করেন। মুসলমানদের অগ্রগতি ও নবীজি (সাঃ) এর ক্ষমার নিদর্শন দেখে মক্কার অধিকাংশ লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

নবীজি (সাঃ) এর ওফাত

নবীজি (সাঃ) মক্কা হতে বিদায় হজ্ব শেষে মদীনায় আসেন। মদীনার আসার পর হিযরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের মাত্রা অধিক হওয়ায় নবীজির পাগড়ীর উপর দিয়ে উষ্ণতা অনুভব করা যাচ্ছিল। তাঁর এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর বিষ মেশানো খাবার খাওয়ার ফলে। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ১১ দিন নামাজে ইমামতি করেন। ক্রমশ অসুস্থতা তীব্র হওয়ায় তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়শার গৃহে অবস্থান করেন। এ সময় তাঁর কাছে মাত্র ৭/৮ দিনার ছিল। তিনি তাও ওফাতের আগের দিন দান করে দেন। অবশেষে ১১ সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি ওফাত লাভ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে গোছল করান হযরত আলী (রাঃ) এবং স্ত্রী আয়শার ঘরে যেখানে অবস্থান করতেন সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

শিক্ষনীয় বিষয়

বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সমগ্র জীবন বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের পার্থিব ও পরলৌকিক জীবনের জন্য যে সকল আদর্শ থাকা প্রয়োজন তার সব কিছুই ছিল নবীজি (সাঃ) এর জীবন আদর্শের মধ্যে। তার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনা তথা সকল ক্ষেত্রে তিনি উত্তম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি দীনহীন জীবন যাপন করলেও কোন দিন কারো কাছে হাত পাতেন নাই।

দানশীলতায় তিনি ছিলেন উত্তম উদাহরণ। চরমভাবে অত্যাচারিত হয়েও তিনি কাউকে কোন দিন অভিশাপ দেননি বা কাউকে গাল মন্দ করেনি। অতি ছোট বেলা হতেই তিনি। ছিলেন বিনয়ী, নম্র ও শান্ত প্রকৃতির সর্বোত্তম একজন মানুষ। সততা, সত্যবাদিতা ও ন্যায় বিচারে তিনি ছিলেন সবসময় অবিচল। ক্ষমার উত্তম দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন নবীজি (সাঃ)। সুতরাং সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনাদর্শই আমাদের জন্য উত্তম শিক্ষা। এই শিক্ষাই যেন আমাদের সকলের জন্য উত্তম পাথেয় হয়ে থাকে।

উপসংহার

সমগ্র মানব জাতির জন্য আল্লাহ পাকের উত্তম উপহার বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)। আল্লাহ পাক নবীজি (সাঃ) এর জীবনাদর্শে আমাদের জীবন পরিচালনা করার তওফিক দান করুন। আমিন।

About মুহম্মদ জিয়াউর রহমান

Leave a Reply

Optimized by Optimole