মূল্যবোধ :
মূল্যবোধ এক ধরনের বিশ্বাস যা আমরা ধারণ করি। মূল্যবোধ সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক হতে পারে। স্পিনোজার মতে জ্ঞানের প্রাণ হল মূল্যবোধ। T. H. Green এর মতে, আত্ম উপলব্ধিই মূল্যবোধ। রয়েসের মতে, আনুগত্য হল মূল্যবোধের সারতত্ত্ব Reverence for life’ হল মূল্যবোধের কেন্দ্রীয় ধারণা।
মূল্যবোধ একটি ব্যাপক বিষয়
সাধারণত সত্য, সুন্দর ও শুভ- এ তিনটিকে মূল্যবোধের মুখ্য বিষয় বলে মনে করা হয়। এদের স্বরূপ, ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হয় মূল্যবিদ্যায় (Axiolog) Value মানবজীবনের এক অনন্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত। কারণ এ মূল্যবোধই নিহিত মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, জীবকুলে তার অনন্য মর্যাদা। নৈতিকতাও মূল্যবোধের অংশ। কেননা ভাল মন্দ ধারণার অন্তর্ভুক্ত নীতিবিদ্যা যা মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত। অনেক দার্শনিক সৌন্দর্য (beauty) ও নৈতিকতা (morality) কে সমার্থক বলে মনে করেন। মানুষের মনুষ্যত্বের অমূল্য সম্পদ মূল্যবোধ। একজন মানুষের জীবনে শুভ, সত্য, সুন্দর মূল্যবোধ থাকলে সে শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত হয়। মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, “রাষ্ট্র সভ্যতা সৃষ্টির ব্যাপারে সহায়ক করতে পারে, কিন্তু সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারে না। সভ্যতা সৃষ্টি করে ব্যক্তি- সুন্দর চিত্ত মানুষের প্রভাবেই সভ্যতা সৃষ্টি হয়।” অর্থাৎ ব্যক্তির মূল্যবোধ দ্বারা যে জাতি গঠিত হয় তার সমষ্টিগত রূপ সভ্যতা। সভ্যতার বিশেষ লক্ষণ মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের প্রতিষ্ঠা। একটি ভাজা ডিমের চেয়ে একটি সনেট উৎকৃষ্ট, এই মনোভাবই মূল্যবোধ। মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ নিকটবর্তী স্থুল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে শিক্ষা ও আনন্দপ্রদ সুকুমার বিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। এর জন্য প্রতীক্ষা করে—এসবই মূল্যবোধের নিদর্শন। ধ্যান, কল্পনা, প্রেম, বুদ্ধি, অনুভূতি, সত্যতা, শ্রম, সহনশীলতা, ধৈর্য্য, সাহস, আত্মবিশ্বাস, এসবের যথার্থ মূল্যদান এবং এগুলোকে অভ্যাসের মাধ্যমে চর্চা করাই মূল্যবোধের চর্চা। একজন মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এসব মূল্যবোধ চর্চা জরুরি বিষয়।
নৈতিকতা:
মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব। বুদ্ধিবৃত্তির কারণে মানুষ অন্যান্য প্রাণি হতে আলাদা। এ কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। ব্যক্তির অভ্যাসের মাধ্যমে যে আচরণ গড়ে উঠে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের বাহ্যিক আচরণকে লক্ষ্য করে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিৎ মূল্যায়ন করা যায়।
নৈতিকতাকে জীবনের নৈতিক বিধি (moral institution of life) বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। নৈতিকতা নৈতিকশক্তি (agenc) বা ন্যায় অন্যায়ের পাথর্ক্যকরণের কর্মক্ষমতার অর্থও প্রকাশ করে থাকে। নৈতিকতা নীতি বা সূত্র এবং চরিত্রের সংলক্ষণ- কেও (traits of character) জড়িত করে। একটি কাজকে তখনই ন্যায় বলা হয়, যখন তা কোন নৈতিক নিয়ম বা মানদণ্ড অনুযায়ী সাধিত হয়। একটি কাজ তখনই ভাল বলা হয়, যখন তা কোন উদ্দেশ্য সাধন করে, অর্থাৎ কোন নৈতিক আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করতে সাহায্য করে।
নীতিবিদ্যা
নৈতিকতা নিয়ে যে বিদ্যা আলোচনা করে তাকে নীতিবিদ্যা বা (Ethics) বলে। নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণের সামগ্রিক আলোচনা করে থাকে। পরম উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সমগ্র জীবন আবর্তিত হয়। এই পরম উদ্দেশ্যকেই নীতিবিদ্যায় পরম কল্যাণ পরম ভাল (Summum bonum or supreme good) বলা হয়। পরম কল্যাণ মানুষের নৈতিক আদর্শ এবং এই পরম কল্যাণের আলোকে মানুষের আচরণের আলোচনা নীতিবিদ্যায় করা হয়ে থাকে।
নৈতিকতা নিয়ে নীতিবিদ্যা আলোচনা করে। ম্যাকেনজী নীতিবিদ্যার যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হল, “আচরণের ন্যায় বা ভাল নিয়ে যে আলোচনা তাকে নীতিবিদ্যা বলা হয়।” John s Mackenzie A Manual of Ethics (১৯৬৪) p-1। এ বিদ্যা আচরণ সম্পর্কীয় সাধারণ মতবাদ এবং এ বিদ্যা ন্যায়ত্ব, অন্যায়ত্ব ও ভাল বা মন্দ প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ক্রিয়াবলির আলোচনা করে। নীতিবিদ্যার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে উইলিয়াম লিলি বলেন, “নীতিবিদ্যা হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ সম্পর্কীয় এমন একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, যা এই আচরণকে ন্যায় বা অন্যায়, ভাল বা মন্দ বা অন্য কোন একই ধরনের পন্থায় বিচার করে।” William Lillie – An Introduction to Ethics (1964) p.1 এথিকস ও মর্যালিটি শব্দদ্বয়ের পার্থক্য রয়েছে। কোন ব্যক্তি নৈতিকতার দিক দিয়ে ভাল, তখন তাঁরা এমন এক ব্যক্তিকে বুঝান, যার ক্রিয়াকলাপ প্রশংসনীয়। এথিকস শব্দটি ব্যবহারিক ক্ষেত্রের পরিবর্তে তাত্ত্বিক ক্ষেত্রের উল্লেখ করে। বস্তুত মানবকুলের সুস্থসমাজ জীবনযাপনের জন্য নীতিবিদ্যায় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। নৈতিকতার কথা অনেকেই বলেন, কিন্তু নৈতিকতা সম্পর্কীয় জ্ঞানের যথার্থ ফলপ্রসূতা তখনই দেখা যাবে, যখন কথার চেয়ে কাজের মাধ্যমে তা বাস্তবে প্রয়োগ হবে।
সক্রেটিসের জীবন নৈতিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
সক্রেটিসের জ্ঞানতত্ত্ব নৈতিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। একজন ব্যক্তি যথার্থ জ্ঞানী ব্যক্তি সৎভাবে জীবনযাপন করে থাকে। জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও সৎভাবে জীবন যাপন না করলে তাকে যথার্থ জ্ঞানী বলা যায় না। সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি know thyself অর্থাৎ নিজেকে জান। নিজের অন্তজ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। Plato Zuvi Republic গ্রন্থে ন্যায়পরায়ণতা কী? এ আলোচনায় নিজের দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালন করাকে ন্যায়পরায়ণতা বলেন। এরিস্টটল জীবনের সব কাজে মধ্যপন্থাকে সর্বোত্কৃষ্ট বলেছেন। ভীরু ও কাপুরষতার মধ্যবর্তী অবস্থাকে সাহস বলেন। সাহস নিয়ে কাজ করলে তা যথার্থ। এরিস্টটল বলেন “অন্যেরা যে কাজ আইনের ভয়ে করে আমি সেই কাজ করি বিবেকের কারণে।” আমাদের কেন নৈতিকতা মেনে চলা উচিৎ। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলেন, “কোন ভাল ফলের জন্য নয় বরং আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কারণে নৈতিকতা মেনে চলা উচিৎ।” যেমন- “শিক্ষার্থী শিক্ষককে সালাম দেয় কর্তব্যের কারণে। শিক্ষক পরীক্ষায় ভাল নম্বর দিবে এই রকম ফল লাভের জন্য নয়। কান্ট বলেন, “আমাদের যে কোন কাজ শর্তহীনভাবে সদিচ্ছার সাথে করা উচিৎ।”
Be a parson ‘মানুষ হও’
Be a parson ‘মানুষ হও’—এটি জার্মান দার্শনিক হেগেলের উক্তি। নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সবার কল্যাণের মধ্যদিয়ে নিজের কল্যাণ উপলব্ধি করতে পারলেই সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়া যায়। “মরে বাঁচো” (Die to live)—এটি জার্মান দার্শনিক হেগেলের উক্তি। মানুষের মধ্যে জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি রয়েছে। মানুষের ইন্দ্রীয় প্রবৃত্তিমূলক জীবন নিম্নতর জীবন। এই নিম্নতর জীবন ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা ও স্বার্থপরতার জীবন। মানুষের এই নিম্নতর জীবনই মানুষের অপরাপর মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখে এবং তাঁর মধ্যে একটা আত্মকেন্দ্রিকতার ভাব জাগায়। এই নিম্নতর জীবনের অবসান ঘটাতে না পারলে মানুষ আত্মবিস্তৃতি লাভ করতে পারে না। যার ফলে সে বৃহত্তর জীবনের স্বাদও গ্রহণ করতে পারে না। ইন্দ্রীয় প্রবৃত্তিমূলক বা নিম্নতর জীবন মানুষের প্রকৃত জীবন নয়। মানুষের প্রকৃত জীবন হচ্ছে বুদ্ধিময় জীবন, যে জীবনে ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা ও স্বার্থপরতার স্থান নেই। প্রকৃত জীবনই পরস্পরের সঙ্গে মানুষকে একাত্মবোধের কথা বলে। আত্মকেন্দ্রিক জীবন পরিহার করার মধ্যদিয়েই মানুষ মহৎ জীবন যাপন করতে পারে। আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর জীবনকে পরিহার করে মহৎ জীবনের অধিকারী হওয়া যায়। বিচারবুদ্ধির দ্বারা কামনা-বাসনা জাত ইন্দ্রীয় প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করতে পারে। মানুষ তার আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতাকে পরিহার করে মহৎ জীবন-যাপন করতে পারে।
সুখ কী?
নৈতিকতার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি গুরুপ্তপূর্ণ যে সুখ কী? কবি কামিনী রায়সহ প্রমুখ কবি লিখেছেন আত্মসুখ প্রকৃত সুখ নয় বরং পরসুখ বা অপরের কল্যাণ করার মধ্যেই প্রকৃত সুখ। ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমী বেনথাম সুখের পরিমাণ লোকের যত বেশি হবে ততই মঙ্গলময় মনে করেন। কিন্তু জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন শুধু অনেক মানুষের সুখ নয় এবং সুখের পরিমাণ বেশি হলে গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং সুখের গুণগত দিকের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। মিলের মতে “একটি সুখী নিম্নশ্রেণির প্রাণি অপেক্ষা একজন অসুখী শিক্ষিত মানুষ ভাল।” অর্থাৎ মিল সুখের গুণগত দিককে গুরুত্ব প্রদান করে। শিক্ষার মাধ্যমে আচরণের গুণগত পরিবর্তন হয় যা কম সুখ উৎপন্ন করলেও কাম্য। আমরা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এই পঞ্চ ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে অথবা বুদ্ধির মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করি। কিন্তু নৈতিকতাকে আমরা কীভাবে জানবো? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, নৈতিকতাকেও ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে বা বুদ্ধির মাধ্যমে জানতে পারি। কিছু দার্শনিক নীতিবোধ, সংঙ্গাবোধ বা বিবেকের কথা বলেন। একটা কাজ করলে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের মন বলে কাজটা খারাপ বা ভাল হয়েছে— এটাই বিবেকবোধ বা সংঙ্গাবোধ।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনা হতে এটা প্রতীয়মান হয় যে নৈতিকতা তাত্ত্বিক নয় বরং ব্যবহারিক। আমাদের আচরণের মাধ্যমে এটা প্রকাশ পায়। বাস্তব জীবনে আমাদের এমন কাজ করা উচিৎ যা দ্বারা কল্যাণ হয় অকল্যাণ যেন না হয়। দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ দ্বারা চালিত হয়ে বুদ্ধির মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ করে সঠিক কর্ম সম্পাদন করা কাম্য। আত্মস্বার্থ অপেক্ষা বৃহত্তর স্বার্থকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা বাঞ্ছনীয়।