মানচিত্র/ম্যাপ:
মানচিত্র হচ্ছে ভূমির প্রতিচ্ছবি। তাতে ভূমির সম্পূর্ণ বস্তু সাংকেতিক চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের সার্ভে বিভাগ সামরিক মানচিত্র প্রস্তুত করে থাকে। মানচিত্রে বিভিন্ন প্রকার রং ব্যবহার করা হয়, যাতে বিভিন্ন প্রকার চিহ্ন সহজেই চেনা যায়।
মানচিত্রের বৈশিষ্ট্য:
মানচিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরুপঃ
ক) এটা সার্ভে করার সময় ভূমিতে বিদ্যমান বস্তুসমুহের সাংকেতিক প্রতিরূপ।
খ) স্থানের স্বল্পতা হেতু অনেক কিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় বস্তু উপস্থাপন করা হয়।
গ) তাতে রণকৌশলের গুরুত্ব সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য থাকে ।
ঘ) ছোট এবং সংকীর্ণ বস্তুসমূহের প্রকৃত আকার ঠিক থাকে না ।
ঙ) বিভিন্ন উপায়ে ভূমির বন্ধুরতা প্রকাশ করা হয়।
চ) প্রতিটি ম্যাপ প্রান্তিক নির্দেশাবলী সম্বলিত।
মানচিত্র পাঠের প্রয়োজনীয়তা:
যে সকল ভূমিতে সামরিক কার্যকলাপ চলে তার প্রতিটি স্থানের বিস্তারিত বিষয়াদি রাখা সম্ভব হয় না। মানচিত্রের উপর ভাল জ্ঞান অর্জনে সক্ষম একজন সৈনিক মানচিত্র দেখেই ভূমি সম্পর্কে একটা ধারনা অর্জন করতে পারে। উত্তম ব্যবহারকারীর কাছে মানচিত্র কোন নির্দিষ্ট জায়গার পরিচয়কারী বন্ধু।
মানচিত্র পাঠের উদ্দেশ্য নিম্নরূপ:
ক) কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে পথ প্রদর্শন এবং মানচিত্র ও ভূমির উপরকার বস্তু ইত্যাদির পরিচিতিতে সাহায্য করে।
খ) মানচিত্র ব্যবহারকারীকে মানচিত্রে ব্যবহৃত তথ্যাদি বুঝতে সামর্থ করা, যেন নির্দিষ্ট অঞ্চলটিকে না দেখেও তিনি ভূমির প্রতিচ্ছবি কল্পনা করতে পারেন এবং রণকৌশল সম্বন্ধীয় ও প্রশাসনিক প্রয়োজনাদি নির্ধারন করতে পারেন ।
গ) যাতায়াত ও বিন্যাস সংক্রান্ত সঠিক তথ্যাবলী আদেশ বা কার্য সম্পাদনের নির্ভুলভাবে দ্রুততার সাথে সরবরাহ সাহায্য করা।
মানচিত্রের প্রকারভেদ:
মানচিত্রকে সাধারণত ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
ক। সাধারণ মানচিত্র
খ। বিশেষ মানচিত্র
তাছাড়াও মাপনী অনুযায়ী সাধারন মানচিত্র তিন প্রকার। যথা:
ক। এ্যাটলাস মানচিত্র:
এগুলি অত্যন্ত ছোট মাপনীর মানচিত্র। ইহাতে সারাদেশ এমনকি সমস্ত পৃথিবী একই সীটে অংকিত হয়ে থাকে। সাধারণতঃ এই সমস্ত মানচিত্রে ভৌগলিক তথ্যাদি পাওয়া যায়। মানচিত্র পাঠের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা যায় না।
খ। স্থান বিবরনী মানচিত্র:
মানচিত্র পাঠের জন্য প্রধানতঃ এটা ব্যবহৃত হয়। ভূমির প্রকৃত ছবি প্রকাশ করা এই সব মানচিত্র প্রস্তুতির উদ্দেশ্য। এইগুলিতে অনেক বড় মাপনী ব্যবহৃত হয়ে থাকে যাতে সম্পূর্ণ বস্তু ভালভাবে প্রকাশিত হতে পারে। সাধারণতঃ বিশেষ উদ্দেশ্যপূর্ণ সামরিক কাজের জন্য এই মানচিত্রসমূহ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
গ। পরিকল্পনা মানচিত্র:
এগুলো অনেক বড় মাপনী ব্যবহৃত হয়ে থাকে যাতে সম্পূর্ণ বস্তু ভালভাবে প্রকাশিত হতে পারে।
বিশেষ মানচিত্র:
যাতায়াত মানচিত্র, সড়ক মানচিত্র, ছোট মানচিত্র, বন্ধুরতা নির্দেশিত মানচিত্র, নৃতত্ত্ব মানচিত্র ইত্যাদি এই ধরণের মানচিত্র। এটা শুধু স্ব স্ব কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সামরিক মানচিত্রে ইহার কোন গুরুত্ব নাই।
মানচিত্রে বর্ণিত নির্দেশাবলী:
মানচিত্র পাঠের পূর্বে ইহার চার পার্শ্বে বর্ণিত নির্দেশাবলী ভালভাবে জানা উচিত। বিভিন্ন প্রকার মানচিত্রে বিভিন্ন ধরণের নির্দেশাবলী দেয়া থাকে। এক ইঞ্চি ও ১ঃ৫০,০০০ মাপনীর মানচিত্রে নিম্নবর্ণিত নির্দেশাবলী থাকেঃ
ক। মানচিত্রের ঊর্ধ্বাংশ।
(১) প্রদেশ বা রাজ্যের নাম।
(২) উত্তর দিকসমূহের পার্থক্য।
(৩) জেলার নাম।
(৪) ম্যাপসীট নং ।
(৫) রোমার।
খ। মানচিত্রের নির্মাংশ।
(১) প্রকাশকের নাম ও পদবী।
(২) প্রশাসনিক সীমারেখার ব্যাখ্যা।
(৩) সাংকেতিক চিহ্ন ।
(8) মানচিত্রের নির্ঘণ্ট
(৫) মাপনী (কথায় লিখন)।
(৬)মাপনী (ভগ্নাংশে প্রকাশিত)।
(৭) মাপনী রেখা (মাইল ও ফর্লং)।
(৮) মাপনী রেখা (গজ)
(৯) সমোন্নতি রেখার মধ্যবর্তী দুরত্ব ।
(১০) মানচিত্রে ব্যবহৃত রং এর ব্যাখ্যা।
(১১) মানচিত্রে স্থানাংক নির্ণয়ের নিয়ম।
নিজ অবস্থান নির্ণয়
একমাত্র কম্পাসের সাহায্যেই ম্যাপকে সঠিকভাবে স্থাপন করা যায়। অন্যান্য নিয়মে ম্যাপ আনুমানিকভাবে স্থাপিত হয় তবে উক্ত ম্যাপের সাহায্যে কাজ করতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। ম্যাপ স্থাপিত হয়ে গেলে ম্যাপ ও ভূমির স্থান বা বস্তুর তুলনা করবার জন্য সর্বপ্রথম ম্যাপে স্বীয় অবস্থান জেনে নেয়া প্রয়োজন। এই কাজে সাধারণতঃ বিশিষ্ট বস্তু বা স্থানের সহায়তা নেয়া হয়। ভূমির উপর স্বীয় অবস্থানের আশেপাশে কোন চৌরাস্তা রেলষ্টেশন, গ্রাম, মসজিদ, পর্বতচূড়া, মন্দির ইত্যাদি থাকলে সেগুলোর দিক ও দূরত্বের অনুমান করে স্বীয় অবস্থান জানতে হবে।
ম্যাপের গ্রিডলাইন
পৃথিবীর ভৌগলিক এবং চৌম্বক উত্তরে অস্থিতিশীলতা বিবেচনা সাপেক্ষে ভূ-পৃষ্ঠের সমআয়তন বিশিষ্ট এলাকা এবং স্থায়ী উত্তর দিকের প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হয়। তাই সেনাবাহিনী ব্যবহারিক কাজের জন্য মানচিত্রের উপর বেগুনী বা লাল রংয়ের উপর উত্তর দক্ষিণে এবং পূর্ব পশ্চিমে সমান্তরাল রেখা অংকন করা হয়েছে। যারা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বর্গক্ষেত্রের সৃষ্টি করিয়াছে। মানচিত্রের রেখাগুলিকে গ্রিডলাইন বলে।
মানচিত্রের কোন অবস্থানের স্থানাংক নির্ণয়ের জন্য গ্রিড পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সমগ্র পৃথিবীকে ২৫ লক্ষ গজের কয়েকটি বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়েছে। এই রূপ প্রতিটি ভাগকে একটি গ্রিড জোন বলে।
আমাদের বাংলাদেশ গ্রিড জোন-২ (রোমান)-বি, (Grid 11-B)। এই নিয়মে নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ২৫ টি ৫ লক্ষ গজের বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি বর্গক্ষেত্রকে A হতে Z (I -কে বাদ দিয়ে) পর্যন্ত ইংরেজি অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি বর্গক্ষেত্রকে পুনরায় ২৫ টি ১ লক্ষ গজের বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়েছে এবং অনুরূপভাবে ইংরেজি অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৫ লক্ষ গজের বর্গক্ষেত্রের অক্ষরগুলি অপেক্ষকৃত ছোট করে লেখা হয়।
প্রত্যেকটি ১০ হাজার গজ বর্গক্ষেত্রেকে পুনরায় ১০০টি ছোট ছোট বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়ে থাকে, যার প্রত্যেকটি ১০,০০০ গজ বর্গক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই গুলি ১ ইঞ্চি ম্যাপে ব্যবহৃত হয়।
১ লক্ষ গজ বর্গক্ষেত্রকে আবার ১০০টি ছোট ছোট বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়, যার প্রত্যেকটি ১০,০০০ গজ বর্গক্ষত্রে পরিণত হয়। এই গুলি ১ ইঞ্চি ম্যাপে ব্যবহৃত হয়।
প্রত্যেকটি ১০ হাজার গড় বর্গক্ষেত্রেকে পুনরায় ১০০টি ছোট ছোট বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়ে থাকে, যার প্রত্যেকটি ১০,০০০ গজ বর্গক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই গুলি ১ ইঞ্চি ম্যাপে ব্যবহৃত হয়।
১/৪ ইঞ্চি ম্যাপে গ্রিড লাইনের নম্বর এক রাশি দিয়ে এবং ১ ইঞ্চি ম্যাপে দুই রাশি দিয়ে লেখা থাকে। ১ ইঞ্চি ম্যাপে প্রত্যেক দশম গ্রিড লাইনটির পাশে তার উৎপত্তিস্থল হতে পূর্ণ দুরত্ব দেওয়া থাকে। অন্যান্য রেখায় পূর্ণ দুরত্ব ডানদিকের তিনটি শূন্য বাদ দিয়ে দুটি রাশি লেখা হয় এবং বামদিকে কোন রাশি থাকলে তা বাদ দেওয়া হয় ।
এই নিয়মে ২৫ লক্ষ গজ বা প্রায় ১৪২০ মাইল পরে একই ছোট অক্ষর ও ৫ লক্ষ গজ বা প্রায় ২৮৪ মাইল পরে একই বড় অক্ষর পুনরায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মনে রাখা উচিত যে, গ্রিড পদ্ধতিতে ম্যাপে ইংরেজি।
দুরত্ব ও স্থানাংক নির্ণয়
গ্রিড লাইনের নম্বর দক্ষিণ দিক হতে উত্তর দিকে এবং পশ্চিম দিক হতে পূর্বদিকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়। উত্তর-দক্ষিণে অংকিত রেখাগুলির নম্বর পশ্চিম দিক হতে পূর্ব দিকে বৃদ্ধি পায় বলে এই রেখাগুলিকে ইষ্টিং লাইন বলে। আর পূর্ব পশ্চিম দিকে অংকিত রেখাগুলির নম্বর দক্ষিণ দিক হতে উত্তর দিকে বৃদ্ধি পায় বলে এই রেখাগুলিকে নর্দিং লাইন বলে।
ম্যাপে গ্রিড লাইনের সাহায্যে কোন স্থানের স্থানাংক নির্দেশ করা হয়। যে বর্গক্ষেত্রের স্থানাংক দিতে হবে, প্রথমে তার বাম দিকস্থ ইষ্টিং লাইনের নম্বর ও পরে তার ভূমিস্থ নর্দিং লাইনের নম্বর লিখতে হবে। এক ইঞ্চি ম্যাপে গ্রিড লাইনের নম্বর দুই রাশিতে থাকায় উক্ত বর্গক্ষেত্রের স্থানাংক চার রাশিতে হয়ে যায়। এই রুপ স্থানাংককে চাররাশি স্থানাংক বলে।
স্থানাংক নির্ণয়ের নিয়ম নিম্নে বর্ণিত ছকটি হতে সহজেই বুঝা যাইত পারে। এই ছকের যে কোন স্থানে যেতে হলে শুধু তার দক্ষিণ পশ্চিম কোণের পথেই তাতে প্রবেশ করা যায়। তার প্রত্যেকেটি সড়কের নাম রাশি দিয়ে রাখা হয়েছে। উক্ত ছকে কোন বর্গক্ষেত্রে যেতে হলে তার নিকটস্থ দক্ষিণ পশ্চিম কোণের চাররাস্তাটিতে পৌঁছতে হবে। যেমন-মসজিদ যাওয়ার জন্য মোটর গাড়িটি ১৩ নং সড়ক ও ৪২ নং সড়কের চৌরাস্তা পর্যন্ত যাবে। অথবা উহাকে ১৩৪২ চৌরাস্তা বলা যায়। ম্যাপে সড়কের স্থলে গ্রিড লাইন অংকিত আছে। এই নিময়েই গ্রিড লাইনগুলির সাহায্যে ম্যাপের কোন স্থানের স্থানাংক দেয়া থাকে। উপরোক্ত মসজিদের স্থানাংক ১৩৪২। উহা চার রাশি স্থানাংক।