ভূমিকা:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে আমরা স্বল্প দেখছি উন্নত ও সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের। এশিয়া তথা সারাবিশ্বে এদেশ রোল মডেল হয়ে উঠবে মুজিববর্ষে এটিই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের দেশের প্রধান সম্পদ এ দেশের জনগণ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্য যেন দক্ষ এবং নিরাপদ মানবসম্পদ হিসেবে বেড়ে ওঠে সেদিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) তরুণ শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেম ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দেশ ও সমাজের কল্যাণের জন্য তরুণ শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান এখন সময়ের দাবি। সে প্রেক্ষিতেই আগামী প্রজন্মকে সমস্ত ভ্রান্ত মতবাদ ও বিপথগামীতা থেকে রক্ষা করতে বিএনসিসির উদ্যোগে সঠিক মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরার বড়এবং শিক্ষার্থীদের জীবনে এর প্রয়োগের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
উদ্দেশ্যঃ
১। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কী তা বুঝতে পারবে।
২। উগ্রবাদ ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ কী তা ব্যাখ্যা করতে পারবে।
৩। সঠিক মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা পাবে।
পরিসর (Scope):
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এর ক্যাডেট ও সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের জন্য আলোচনার সুবিধার্থে বিষয়বস্তুকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১ম ভাগে সন্ত্রাস/জঙ্গিবাদ এর ধারনা, ২য় ভাগে উগ্রবাদ-ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং ৩য় ভাগে সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা ও অনুশীলনের গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বিষয়সমূহের সংক্ষিপ্ত তালিকাঃ
১। সন্ত্রাস/জঙ্গিবাদ: পরিচয়, কুফল, শান্তিমূলক ব্যবস্থা, কারণ উদ্ঘাটন ও নিরস
২। উগ্রবাদ-ধর্মীয় বিধিনিষেধ: ধারণা প্রদান, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ক্ষতিকর দিক ও সঠিক পথের অনুসন্ধান
৩। সঠিক মূল্যবোধ: আলোচনা ও অনুশীলনের গুরুত্ব।
বিষয় সমূহের ধারাবাহিক বর্ণনাঃ
১। সন্ত্রাস/জঙ্গিবাদ:
পরিচয়ঃ সন্ত্রাস অর্থ ভয় বা ত্রাসের মাধ্যমে কোন কিছু আদায় করা বা আদায়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। সন্ত্রাসের পন্থা অবলম্বন করে কোন মতবাদ প্রচার/প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টাই জঙ্গিবাদ। এই অর্থে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জঙ্গিবাদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
সন্ত্রাস/জঙ্গিবাদের কুফল:
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সামাজিক জীবন বিপর্য হয়। যখন তখন যে কেউ অপমৃত্যুর শিকার হতে পারে। পারস্পারিক বিষেষ বেড়ে যায়। জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা:
মহান আল্লাহতায়ালা সন্ত্রাসকে হত্যার চেয়ে জগন্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মদদ দাতাদের জন্য কুরআন ও হাদিসে কঠিন শান্তির কথা বলা হয়েছে। সরকারিভাবেও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে কঠোরতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
কারণ উদ্ঘাটন ও নিরসন:
সন্ত্রাসের কারণ উদ্ঘাটন ও নিরসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য দারিদ্র্য, সুশিক্ষার অভাব, বেকারত্ব ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি জোর দিতে হবে।
২। উগ্রবাদ-ধর্মীয় বিধিনিষেধ:
সঠিক ধারণা প্রদান, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ক্ষতিকর দিক ও সঠিক পথের অনুসন্ধান, সন্তান জন্মের পর নৈতিক শিক্ষা তথা সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা না পেলে সন্তান বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে সন্তানকে প্রথমে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। উগ্রবাদ ও সহিংসতারোধে সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অপরাধের আইনি শান্তি সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এক ভয়াবহ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যারা এ অবস্থার সৃষ্টিকারী তারা অধিকাংশই অল্প বয়সী তরুণ-যুবক। যাদের পিছনে রয়েছে অদৃশ্য ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী এক অপশক্তি। যারা ধর্মের নামে পথহারা তরুণ যুবাদের ব্যবহার করে অসংখ্য অনিরাপরাধ মানুষের প্রাণহানি করে চলেছে। এদের মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া উচ্চবিত্ত দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকও রয়েছে। যা আমাদেরকে ভয়ানকভাবে ভাবিয়ে তুলছে। আধুনিক জীবনের স্বপ্ন দেখা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও এ দলে অংশগ্রহণ করছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ আজ হুমকির মুখে। এ বিপজ্জনক সমস্যা থেকে মুক্তিলাভের উপায় হলো সমাজের সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৩। সঠিক মুল্যবোধ: আলোচনা ও অনুশীলনের গুরুত্ব:
যেহেতু আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তাই শিশু-কিশোর-তরুণদেরকে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক সুশিক্ষায় সঠিকভাবে গড়ে তুলতে ধর্মীয় শিক্ষা ও পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আল্লাহতায়ালা পরিবার ও সমাজের কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে মুমিনগন, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর”। (সুরা তাহরিম আয়াত ৬)
অর্থাৎ দুনিয়ার সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতেই জাহান্নামের ভয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চলমান সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মহামারি থেকে সমাজ ও জাতিকে মুক্ত করতে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ কারণেই সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে মহৎ করে গড়ে তোল এবং তাদেরকে উত্তম আদব তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দাও। সন্তানকে আদব তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া এক সাগর পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী সাদকা করা থেকেও উত্তম।’ ( তিরমিজি, মিশকাত)
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে নতুন প্রজন্ম ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত বললেই চলে। পক্ষান্তরে, অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের ব্যাপক তৎপরতার কারণে কোমলমতি কিশোর-কিশোরী ও তরুন-তরুনীরা ভ্রান্ত মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। আবার অর্থের পিছনে ছুটে চলা ব্যস্ত বাবা মা তাদের সন্তানদের জন্য পড়াশোনার নামে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ খরচ করলেও সঠিক পরিচর্যা ও সঙ্গ দেয়ার অভাবে বিপথগামী হচ্ছে আগামী প্রজন্ম। যার কারণে পরিবারের সাথে বসবাস করা সত্ত্বেও আদরের সন্তান হয়ে উঠছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। সুতরাং, পরিবার ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অর্থের পিছনে পাগলের মতো ছুটে চলার অস্বাভাবিক গতি থামিয়ে সন্তানকে সময় দেয়া এবং নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলা অতীব প্রয়োজন। উগ্রবাদ শুধুমাত্র একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণির সমস্যা ভাবলে ভুল হবে। বিশ্বজুড়ে বর্ণ এবং ধর্মভেদে উগ্রবাদী রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘৃণা থেকে উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। আর ঘৃণার জন্ম ভয় থেকে। ভয়ের জন্ম অজ্ঞানতা ও অক্ষমতা থেকে। ভয় জাগিয়ে মানুষকে সাময়িক অক্ষম ও বিচ্ছিন্ন করে রাখা জঙ্গিবাদের উদ্দেশ্য। ভয় আর বিদ্বেষের কারণে সুন্দর এই পৃথিবী হয়ে উঠেছে একটি বৃহৎ কারাগার। তাই সন্ত্রাসবাদের প্রভাব ব্যাপক এবং বিধ্বংসী। মানব আচরণে অভীষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে জ্ঞান দান করাকে শিক্ষা বলে। অধ্যয়ন সব সময় জ্ঞানার্জনের সমার্থক নয়। শিশুর বা সন্তানের নৈতিক শিক্ষার সুতিকাগার হলো তার পরিবার। পরিবারের বড়রা | যদি সৎ, সুন্দর ও পরিশীলিত চরিত্র ও মার্জিত আচরণের অধিকারি হন, তবে সন্তানেরা তা দেখেই শিখবে।
মানুষ সামাজিক জীব। পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাব সমাজ জীবনে প্রকট। সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছায়া শিক্ষার্থীদের মন-মানস ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। তাই সুশিক্ষার জন্য সুশাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতাও জরুরি।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায়, সন্ত্রাস, উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ থেকে আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। বিএনসিসির কর্মপরিকল্পনায় এ বিষয়টিকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি সম্ভব। আর মানুষ সচেতন হলেই ভবিষ্যতের অপার সম্ভাবনার উজ্জ্বল আকাশ থেকে জঙ্গিবাদের কালো মেঘ সরে যাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
বিষয় সমূহের সারসংক্ষেপঃ
১। সন্ত্রাস / জঙ্গিবাদ সমাজ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। তাই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূলে সকলকে সোচ্চার হতে হবে।
২। উগ্রবাদ- ধর্মীয় বিধিনিষেধ ব্যক্তিজীবনকে বিপর্যন্ত করে।
৩। সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা এবং অনুশীলন সবার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।
প্রশ্নোত্তর:
১। সন্ত্রাস/জঙ্গিবাদ বলতে কী বোঝ? এর ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচনা কর।
২। সঠিক মূল্যবোধের গুরুত্ব আলোচনা কর।