রক্তদানের সামাজিক গুরুত্ব

ভূমিকা

রক্তদান হচ্ছে সবচেয়ে একটি মানবসেবা। এটা এক প্রকার এবাদত। একজন মূমুর্য রোগীকে রক্তদান করে প্রানে বাচাঁনোর ঋন শোধ করা যায় না। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের আর্শিবাদে জীবন ও জগতের উন্নতি হওয়া সত্বেও রক্তের কোন বিকল্প এখনও কেউ আবিষ্কার করতে পারে নাই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা রক্তদান সম্পর্কে সচেতন নই। রক্তদানের কথা শুনলে আমরা ভয় পাই কিন্তু আমরা যদি রক্তদান সম্পর্কে জানতে পারি ও নিজেকে সচেতন করতে পারি নিজেকে মানব সেবায় উজ্জীবিত করতে পারি তাহলে আমরা সার্থক জীবন উপভোগ করব।

উদ্দেশ্য

রক্তদানের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালনে সম্যক জ্ঞান প্রদান করা।

রক্তদান কি?

কোন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়া ও এই রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয় অথবা অংশীকরণের মাধ্যমে ঔষধে পরিনত করে প্রয়োজনে অন্য মানব শরীরে প্রদান করা হয়। উন্নত বিশ্বে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রক্তদান করেন।

রক্তদানের ইতিহাস 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে স্বেচ্ছায় রক্তদানের প্রচলন শুরু হয়। ১৯৪২ সালের যুদ্ধ ফেরত আহত সৈনিকদের সাহায্য করার জন্য রক্তদানকারীদের প্রয়োজন ছিল। কলকাতার প্রথম ব্লাড ব্যাংকটি ১৯৪২ সালের মার্চে অল ইন্ডিয়া ইনিস্টিটিউট অফ হাইজিন এন্ড হেলথ এ স্থাপিত হয়। এবং রেডক্রস দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৯৫৪ সালে মোম্বাইয়ে সোনালী রক্তদান ক্যাম্পে নীলা মৌলগ্নকার শুরু হয়। ১৯৬০ এর দশকে অনেকগুলো ব্ল্যাড ব্যাংক বিভিন্ন শহরে খোলা হয়। যা সারা দেশ জুড়ে দেখা যায়। ১লা অক্টোবর জাতীয় স্বেচ্ছাসেবী রক্তদান দিবস ঘোষনা করা হয়েছে।

রক্তের গ্রুপ ও কে কাকে রক্ত দিতে পারবে

আমরা জানি মানুষ ভেদে রক্তের গ্রুপের পার্থক্য হয়। সাধারণত A+, A-, B+, B-, AB+, AB-, O+, O গ্রুপের রক্ত থাকে। এর মধ্যে পৃথিবীতে সবচেযে O+ গ্রুপের মানুষের সংখ্যা বেশী।

নিচের সারণী থেকে আমরা সহজেই দেখে নিতে পারি কে কাকে রক্ত দিতে পারে

রক্তের গ্রুপযাদের দিতে পারবেযাদের কাছ থেকে নিতে পারবে
A+A+, AB+A+, A-, O+, O-
A-A+, A-, AB+, AB-A-, O-
B+AB+সকল গ্রুপ
B-AB+, AB-A-, B-, O-, AB-
AB+B+, AB+B+, B-, O+, O-
AB-B+, B-, AB+, AB-B-, O-
O+A+, B+, AB+, O+O+, O-
O-সকল গ্রুপO-
রক্তদানের উপকারিতা

ক) রক্তদানের প্রথম এবং প্রধান কারণ, একজনের দানকৃত রক্ত আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচাবে। 

খ) রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং রক্তদানের ২ সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকার জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। বছরে ৩ বার রক্তদান আপনার শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলার সাথে সাথে নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য রক্তদান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।

গ)  নিয়মিত রক্তদান করলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।

ঘ) আরেক গবেষণায় দেখা যায়, যারা বছরে দুই বার রক্ত দেয় অন্যদের তুলনায় তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্ষেত্রে অনেক কম পরিলক্ষিত হয়েছে। চার বছর ধরে ১২০০ লোকের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়েছিলো।

ঙ) নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে নিজের শরীরে বড় কোনো রোগ আছে কিনা তা বিনা খরচে জানা যায়। যেমন: হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) ইত্যাদি। 

চ) প্রতি পাইন্ট (এক গ্যালনের আট ভাগের এক ভাগ) রক্ত দিলে ৬৫০ ক্যালরি করে শক্তি খরচ হয়। অর্থাৎ ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ছ) রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত পুণ্যের বা সওয়াবের কাজ। একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানব জাতির জীবন বাঁচানোর মতো মহান কাজ। পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৩২ নং আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানব জাতির জীবন বাঁচানোর মতো মহান কাজ।

মানব দেহের রক্তের সাধারন ধারনা

রক্ত এক ধরনের যোজক কলা। একজন পুর্ন বয়স্ক সুস্থ মানুষের দেহে গড়ে ৫ থেকে ৬ লিটার রক্ত থাকে। রক্তের প্রধান দুটি উপাদান থাকে। যথা:

(১) রক্ত রস বা প্লাজমা:

রক্তের হাল্কা হলুদ বর্ণের তরল পদার্থকে প্লাজমা বলা হয় । প্লাজমা তে রক্ত কনিকা ভাসমান থাকে রক্ত রস বা প্লাজমাতে শতকরা ৯২ ভাগ পানি থাকে। এছাড়াও থাকে গ্লুকোজ, অ্যামাইনো এসিড, ফ্যাটি এসিড, গ্লিসারল, খনিজ লবন, হরমোন, ভিটামিন, ইউরিয়া, এন্টিবডি, অক্সিজেন, কার্বনডাইঅক্সাইড, ও অন্যান্য বর্জ।

(২) রক্ত কণিকা:

রক্ত কণিকা রক্ত রসের মধ্যে ছড়ানো থাকে। রক্তে শতকরা ৪৫ ভাগ রক্ত কণিকা থাকে। আমাদের রক্তে তিন ধরনের রক্ত কণিকা রয়েছে- লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কনিকা ও অণুচক্রিকা।

রক্তের কাজ

ক। রক্ত সারা দেহের পানি ও তাপের সমতা রক্ষা করে।

খ। লোহিত রক্ত কনিকা হিমোগ্লোবিনের সাহায্যে ফুসফুস থেকে কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে।

গ। শ্বেত রক্ত কণিকা রোগ জীবাণু ধ্বংস করে আমাদের দেহকে সুস্থ রাখে। 

ঘ। দেহের কোন স্থানে কেটে গেলে অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে ফলে ক্ষত স্থান থেকে রক্তপাত বন্ধ হয়। 

ঙ। রক্ত রসের মাধ্যমে গ্লুকোজ, অ্যামাইনো এসিড, কার্বনডাইঅক্সাইড ইত্যাদি দেহের বিভিন্ন স্থানে পরিবাহিত হয়।

রক্তদানে সাবধানতা

১) প্রাপ্ত বয়স্ক যেকোন সুস্থ মানুষ অন্যকে রক্ত দিতে পারে। রক্ত দেয়ার জন্য উপযুক্ত মহিলা ও পুরুষ যাদের বয়স ১৮- ৪৫ বছর। পুরুষদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ৪৭ কেজি বা তার উর্ধে হতে হবে এবং মহিলা দের ক্ষেত্রে ৪৫ কেজি বা তার উর্ধে হতে হবে।

২) যাদের ৩ বছরের মধ্যে জন্ডিস হয়েছে, যাদের রক্ত বাহিত জটিল রোগ রয়েছে। ৪ মাসের মধ্যে যারা রক্ত দিয়েছে। 

৩) যারা ৬ মাসের মধ্যে বড় কোন অস্ত্রোপাচার করিয়েছেন। মহিলাদের ক্ষেত্রে যারা গর্ভবতী অথবা যাদের মাসিক বা ঋতু স্রাব চলছে।

৪) ব্যবহৃত সূচ সিরিঞ্জ জীবাণু মুক্ত হতে হবে।

উপসংহার

দুঃস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত ও সমাজের অবহেলিত মানুষকে এগিয়ে নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ কর্মেও ভূমিকা অপরিসীম। মূমুর্ষ মানুষকে রক্তদান করার মত মহৎ আর কিছু হতে পারে না। তাই সকল পেশা ও শ্রেনীর মানুষের উচিৎ রক্তদানের মাধ্যমে আর্তমানব সেবায় এগিয়ে আসা।

About মুহম্মদ জিয়াউর রহমান

Check Also

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সংগঠন/ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিচিতি ও সমন্বয়

ভূমিকাঃ  বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে প্রতি বছর কোন …

Leave a Reply

Optimized by Optimole