মুক্তিযুদ্ধ ও  সেক্টরসমূহ

ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন ও শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য ১৯৪৭ সাল থেকে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে মুক্তি সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির যে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ তাকেই মুক্তিযুদ্ধ বলে। এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমস্ত বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার। সেক্টরে বিভক্ত করে সুশৃঙ্খল যুদ্ধ পরিচালনা ছাড়া এদেশের মুক্তি আনা সম্ভব ছিল না। পৃথিবীর ইতিহাসে যে কতগুলো মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে সেক্টর ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ খুব কম দেশেই তা পরিলক্ষিত হয়েছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সেক্টর গঠনের পরিকল্পনা, গঠন, সেক্টর সমূহের সাথে অন্যান্য আঞ্চলিক পরিষদসহ অন্যান্য বিভাগের সুসামঞ্জস্যতা বিশেষ তাৎপর্যের দাবি রাখে। বিশেষ করে সেক্টর কমান্ডারদের অতুলনীয় দক্ষতা ও দেশপ্রেম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।

সেক্টর গঠন

২৬ মার্চ যে লড়াই সংগ্রাম শুরু হয় তা সমন্বয় করার তাগিদ অনুভব করে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সামরিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য বাঙালি ত্যাগী অফিসারদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে প্রবীণ বাঙালি সমর নায়ক কর্ণেল এম. এ. জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। অত:পর ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জুন মাসের প্রথম দিকে মুজিবনগর সরকার উপলব্ধি করেন যে, প্রথাগত যুদ্ধ চাপিয়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল শক্তিশালী প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই কলকাতা ৮ নং থিয়েটার রোডে ১১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত কলকাতায় সিনিয়র অফিসারদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। সম্মেলনে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সমস্যা এবং ভবিষৎ সামরিক পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক লেঃ কর্ণেল এম. এ রবকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়। এছাড়াও যে সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা ছিল ।

১। বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ।

২। গেরিলা যুদ্ধের আয়োজন।

৩। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে ব্যাটালিয়ন ফোর্স এবং সেক্টর ট্রুপস এর মাধ্যমে সংগঠিত করে তোলা।

৪। সমগ্র বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের সুবিধার্থে একটি নৌ সেক্টরসহ ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা। এছাড়া অনেকগুলো সাব সেক্টরও গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি সেক্টর একটি একটি নির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক ছিল এবং একজন সেক্টর কমান্ডার সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

সেক্টর কমান্ডারদের নাম ও বন্টনকৃত দায়িত্বস্থল

সেক্টরদায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডারএলাকা
১ নং সেক্টর✓মেজর জিয়াউর রহমান(এপ্রিল-জুন) ✓মেজর রফিক (জুন-ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম, পাবর্ত চট্টগ্রাম এবং ফেনী নদী পর্যন্ত অঞ্চল
২ নং সেক্টর✓মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ✓মেজর এটিএম হায়দার (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) নোয়াখালী, কুমিল্লা, আখাউড়া-ভৈরব এবং ঢাকা জেলার ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ।
৩ নং সেক্টর✓মেজর শফিউল্লাহ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ✓মেজর নুরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর- ডিসেম্বর)আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্বদিকে কুমিল্লা জেলার অংশ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা জেলার অংশ বিশেষ। 
৪ নং সেক্টর✓মেজর সি. আর. দত্তসিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল, খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তরদিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত।
৫ নং সেক্টর✓মেজর মীর শওকত আলীসিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল, সিলেটের ডাউকি সড়ক থেকে সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার সীমানা পর্যন্ত এই সেক্টর বিস্তৃত ছিল।
৬ নং সেক্টর✓বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার এম. কে বাশাররংপুর জেলা এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের  ঠাকুরগাঁও মহকুমা পর্যন্ত এই সেন্টার বিস্তৃত ছিল। পরে রংপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের অঞ্চল যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে এই সেক্টরের অধীনে আনা হয়।
৭ নং সেক্টর✓মেজর নজমুল হক সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন। জুলাই মাসে মেজর নজমুল হক এক মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর কাজী নূরুজ্জামানকে সেক্টরের সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়।দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া অঞ্চল ।
৮ নং সেক্টর✓মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত)✓মেজর এম এ মঞ্জুর (আগস্ট-ডিসেম্বর)কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর জেলার অধিকাংশ অঞ্চল এবং খুলনা জেলার দৌলতপুর, সাতক্ষীরা পর্যন্ত এই সেক্টরের বিস্তৃতি ছিল । 
৯ নং সেক্টর✓আব্দুল জলিল (ডিসেম্বর পর্যন্ত) ✓এম এ মঞ্জুর (অতিরিক্ত দায়িত্ব)দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনা জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা।
১০ নং সেক্টরএই সেক্টরটি নৌবাহিনীর অধীনে ছিল। নৌ কমান্ডোরা বিভিন্ন সেক্টরে নির্দিষ্ট মিশনে নিয়োজিত থাকাকালে সেক্টর কমান্ডারদের অধীনে কাজ করতেন। এই সেক্টরের কোনো নির্দিষ্ট সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। আগস্ট মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠিত হয়। ৯ নভেম্বর প্রথম নৌবহর ‘বঙ্গবন্ধু’ নৌবহর উদ্বোধন করা হয়।দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথ ১০ নং সেক্টরে অধীনে ছিল।
১১ নং সেক্টরমেজর আবু তাহের (নভেম্বর পর্যন্ত) ফ্লাইট লে. এম হামিদুল্লাহ (৩ নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত) মেজর আবু তাহের এই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। নভেম্বর মাসে তিনি গুরুতরভাবে আহত হলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ এই সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।কিশোরগঞ্জ ব্যতীত সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল।

সেক্টরভূক্ত

সঠিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করার স্বার্থে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। গোড়ার দিকে এই সেক্টর বা যুদ্ধাঞ্চলের সংখ্যা ছিল চারটি। পরে তা বাড়িয়ে করা হয় ছয়টি এবং জুলাই এর বৈঠকের পর করা হয় ১১ টি। প্রত্যেকটি সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ ও চিহ্নিত করা হয়।

সেক্টর ও বেসামরিক আঞ্চলিক প্রশাসন

আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপন ও পরিচালনা ছিল মুজিবনগর সরকারের একটি সম্পূর্ণ চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা, যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম থাকবে, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য হবে যুদ্ধে নিয়োজিত সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করা। এই লক্ষ্যে ১১ টি সেক্টরের সাথে ১১ টি আঞ্চলিক পরিষদ [Zonal Administrative Council] প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পরিষদগুলোতে নির্দিষ্ট এলাকার এম.এন.এ/ এম.পি.এ. সদস্য বা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য ছিলেন। এই পরিষদকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই প্রশাসকগণ কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। শরণার্থী সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক সামরিক-বেসামরিক বিষয়াবলির সুষ্ঠু সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণভার এই প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর উপর ন্যস্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন ও পূর্ণ সহযোগিতা করা।

সেক্টর ও বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়

সেক্টর গঠনের পর মুজিবনগর সরকার তিনটি ব্রিগেড আকারে ফোর্স গঠন করেছিল। জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স। যুদ্ধের জন্য নিয়োজিত গণবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনী, বিশেষ বাহিনী, গেরিলা বাহিনী অঞ্চলভিত্তিক বাহিনীগুলো সেক্টর কমান্ডারদের নির্দেশনা, সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। একটি সেক্টরে কত জন মুক্তিযোদ্ধা তার পরিমাণও নির্দিষ্ট ছিল। সাব সেক্টরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাও সুনির্দিষ্ট ছিল। এতে করে যুদ্ধে চেইন অফ কমান্ড বজায় থাকে।

উপসংহার

বিভিন্ন সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। দেশ মাতৃকার এই যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার, সাব-সেক্টর কমান্ডার, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার, কোম্পানি কমান্ডার সবারই আত্মত্যাগ ছিল অতুলনীয়।

About মুহম্মদ জিয়াউর রহমান

Check Also

ক্যাডেট পদোন্নতি পরীক্ষার দরকারী প্রশ্ন ও উত্তর-০২

প্রশ্নঃ দুর্যোগ কাকে বলে? দুর্যোগের প্রকারভেদ কয়টি ও কি কি?  উত্তরঃ যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বিপন্ন …

Leave a Reply

Optimized by Optimole