মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও নেতৃত্ব

ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন ও শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য ১৯৪৭ সাল থেকে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে মুক্তি সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিকে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়। এই যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা যেমন আপনা আপনি অর্জিত হয়নি তেমনি যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়াও সেটি সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে নেতৃত্বের ভূমিকায় যিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিয়মাতান্ত্রিক এবং ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালিকে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি এই ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম থেকে বাঙালিদেরকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানে আপামর জনসাধারণ দেশের স্বাধীনতার জন্য যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে। জাতি পায় একটি পতাকা, মানচিত্র ও সার্বভৌমত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও নেতৃত্ব

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মাধ্যমে দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম নেয় একটি হলো পাকিস্তান এবং অন্যটি ভারত। তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বহু রকম পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দুটি ভূখণ্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান লাভ করে। ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তানের জন্ম ছিল অভূতপূর্ব ও অবাস্তব। এর দুটি অংশ পরস্পর থেকে ১২০০ মাইল দ্বারা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। উভয় অঞ্চলের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, ঐতিহ্য ও অর্থনীতি ছিল পরস্পর থেকে পৃথক। একমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা শুভ হয়নি যার পরবর্তী ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। পাকিস্তান লাভের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকচক্র পূর্ব বাংলার জনগণকে অর্থনীতি, রাজনীতি ও শাসনতান্ত্রিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোণঠাসা করে রাখে। সেই সাথে প্রদর্শন করে চরম অবহেলা। সর্বোপরি সচেতন বাঙালিদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে। এই শোষিত বঞ্চিত বাঙালি জাতি মায়ের ভাষার দাবীতে প্রথম সোচ্চার হয়। ভাষাগত তথা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিহত করতে বাঙালিদের যে আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয় তা হতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠে। ভাষা আন্দোলনে অর্জিত হয় অধিকার আদায়ের প্রথম ধাপ। ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালিরা অধিকার আদায় করতে শেখে। এই শিক্ষা, সচেতনতাবোধ পরবর্তী আন্দোলনগুলোর উদ্দীপক হিসেবে কাজ করতে থাকে। চুয়ান্নর নির্বাচনে বাঙালির জয়, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার অধিকার আদায় করা সম্ভব হয়। ৬৬-এর ছয় দফা প্রস্তাব বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। এই ছয় দফার মধ্যেই এ দেশের স্বাধীনতার বীজ বপন হয়। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব গণ-আন্দোলনে ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন সবই ছিল সময়োপযোগী ও ধারাবাহিক আন্দোলন যার সফল পরিণতি ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ।

হঠাৎ করেই এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি বা এদেশের মুক্তি আসেনি এর জন্য প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করতে হয়েছিল, যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল। সেই অভাবটা পূরণ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আওয়ামী লীগ গঠনসহ মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব গণআন্দোলনের প্রথম ধাপ ভাষা আন্দোলন থেকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে জেল জুলুম সহ্য করেছেন। তাতে তিনি দমে যাননি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে পাকিস্তান মুসলিম লীগকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। যদিও এসময় নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হাজী দানেশ প্রমুখ নেতা। কিন্তু তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল কঠোর পরিশ্রম, দেশের প্রতি চরম মমত্ববোধ। যার ফলশ্রুতিতে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানকে যোগ্য আসনে বসাতে দ্বিধা করেন নি। তিনি ৫৪-এর নির্বাচন পরবর্তী ৬২-এর ছাত্র আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ভারত-পাকিস্তান (১৯৬৫) যুদ্ধে দেশের অসহায়ত্ব দেখে স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে ছয় দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ছিল প্রকারান্তরে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। ছয়টি দফাকে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে তা বাস্তবে আন্দোলনে রূপায়িত করেন। ছয়টি দফা শুধু লিখিত আকারে দফা থাকেনি তা হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফা প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আপোষ করেন নি। ফলে তাকে পোহাতে হয়েছে আগরতলার মত মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলা। তিনি মামলাকে জয় করে এক দলীয় নেতার আসন থেকে সমগ্র জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তালুকদার মনিরুজ্জামানের ভাষায়, “Hebecame the ventiable symble of Bengali nationalism.” কারণ তার পিছনে ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালবাসা। তিনি মানুষের ভালবাসার সাথে বেঈমানী করেননি। তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি মনে করেন আইয়ুব শাহীর পতন হলে বাঙালি স্বায়ত্বশাসন পাবে নির্বাচন পাবে। শেষ অবধি ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের চাপে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের নেতা সাড়ে সাত কোটির নয়নের মনি শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুরূপে। তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিনিয়ে আনেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাঙালির আবাসভূমিকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করেন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু ইয়াহিয়া গং ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে তালবাহানা করতে থাকলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগের ডাক দেন।

অসহযোগ আন্দোলন সফল হলে জনগণ বঙ্গবন্ধুর কাছে সঠিক ঘোষণার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ সেই কাঙ্খিত ঘোষণা দেন এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়।

২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাতে গণহত্যার মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু করলে এদেশের জন প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্ব ঘোষণা করলে আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তিনি গ্রেফতার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কারাগারে বন্দি হয়ে থাকেন। তখন এ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১০ এপ্রিল গঠিত অস্থায়ী মুি সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতাকে অনুমোদন দান করে। পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচার করে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তাকে মুক্তি দেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। সবকিছু নতুন করে গড়ে তোলেন। এক বছরের মধ্যে জাতিকে একটি নতুন সংবিধান উপহার দেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় যখন সোনার বাংলা গড়ার কাজে হাত দেন সে সময় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সনে বাঙালির কিছু কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের অনেককে হত্যা করে।

উপসংহার

শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি মনে প্রাণে বাঙালি। তার লালিত স্বপ্ন ছিল বাঙালির স্বাধীনতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন তিনি যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বাস্তবায়িত করেন। বাংলা ও বাঙালি তার কত প্রিয় তা বোঝা যায়। ফাঁসির রায় শুনে তার উক্তি থেকে। তিনি শাসকগোষ্ঠীকে বলেছিলেন, “আমাকে মেরে ফেলে দাও, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমার মরদেহটা তোমরা বাঙালির কাছে পৌঁছে দিও।” তাই তো তাঁকে ছাড়া বাঙালির ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তার কীর্তি থাকবে অম্লান। আর এ জন্য কবি অন্নদাশংকর রায় লিখেছিলেন-

“যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি বহমান, 

ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”।

About মুহম্মদ জিয়াউর রহমান

Check Also

ক্যাডেট পদোন্নতি পরীক্ষার দরকারী প্রশ্ন ও উত্তর-০২

প্রশ্নঃ দুর্যোগ কাকে বলে? দুর্যোগের প্রকারভেদ কয়টি ও কি কি?  উত্তরঃ যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বিপন্ন …

Leave a Reply

Optimized by Optimole