পরিবেশ রক্ষা

ভূমিকা: 

কয়েকশ বছর আগে যতটা সবুজ ছিল আমাদের পৃথিবী, এখন তা অনেকাংশে কমে গেছে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবী দূষিত নরকে পরিণত হচ্ছে। শুধু যে শিল্প বিপ্লবই দায়ী তা নয়। বায়ুমন্ডলে দিনে দিনে কার্বন-ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়াতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবী আজ ধ্বংসের মুখে পড়েছে।

উদ্দেশ্য:

পরিবেশরক্ষা বিষয়ে সম্যক ধারণা প্রদান করা।

পরিবেশ কী?

জীবন, পরিবেশ ও উন্নয়ন একই সূত্রে গাথা। একটি আরেকটির পরিপূরক। পরিবেশদূষণ একটি দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। পরিবেশ দূষণের সাথে জলবায়ুর পরিবর্তন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব এখন সর্বত্র বিরাজমান। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি বিষয় প্রতীয়মান যে, দিন দিন পরিবেশে বাতাসের দূষণমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ এবং ওজনস্তর বেড়ে যাওয়া। আমাদের চারপাশের জলবায়ু, গাছপালা, মাটি, অন্যান্য প্রাণি, মানুষ, জৈব ও অজৈব সমস্ত কিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ । পৃথিবীর পরিবেশ জীববিকাশের পক্ষে অনুকূল বলেই এই পৃথিবীতে মানুষের বাস।

পরিবেশ দূষণের কারণ:

এই পৃথিবীর পরিবেশ ক্রমশই দূষিত হয়ে মনুষ্যবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। নিম্নে প্রদত্ত কারণগুলো পরিবেশ দূষণের জন্য উল্লেখযোগ্য:

ক। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ, মানুষের ব্যবহৃত বর্জ্য পদার্থ এসবই নিয়মিত জলকে দূষিত করছে। বায়ুদূষণ ও জলদূষণ বাড়ছে।

খ। গাছপালা বায়ুতে অক্সিজেনের জোগান দেয়, বায়ুর ধূলা, ধোঁয়া প্রভৃতি শুষে নেয়, বৃষ্টি ঘটায়। কিন্তু মানুষ বনজঙ্গল দ্রুত ধ্বংস করে পশুপাখি নিধন করছে। এই পশুপাখি প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

গ। বন ও প্রাণি ধ্বংসের ফলে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে।

ঘ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হওয়াতে নগরায়ন হচ্ছে। ফলে আকাশে ওজোন স্তর বেড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব : 

ক। দূষিত পরিবেশের প্রভাবে জীবজগতের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য নষ্ট হয় এবং ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এতে মানুষের জীবনধারা ব্যাহত হয়।

খ। পরিবেশের অপরিহার্য বিভিন্ন উপাদান যেমন বায়ু, পানি ও শব্দদূষণের ফলে পরিবেশ সংকট দেখা দেয়। পরিবেশ সংকটে মানবজীবন বিপুল পরিমাণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জীবজগতের স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।

গ। পরিবেশের উপাদানগুলো দূষিত হওয়ার ফলে নানা রোগ ব্যাধি ছড়ায়। পানি দূষণের ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, চুলকানি ইত্যাদি রোগ হয়। শব্দ দূষণের ফলে হৃদরোগ, মাথাব্যথা, মানসিক সমস্যা ও কানের অসুখ দেখা দেয়। বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুসের অসুখসহ নানা প্রকার জটিল রোগ হয়। এছাড়া মাটিদূষণের ফলে রোগ উৎপাদক বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব ছড়ায়। জমির উর্বরতা শক্তি কমে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে খাদ্য ও অর্থ সংকট দেখা দেয়। পরিবেশ দূষণের অনেক কারণের মধ্যে নগরায়ন, শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ, গাছপালা কর্তন, সার, ওষুধ, কীটনাশকসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ও পশুপাখির মৃতদেহ ফেলা, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, গাড়ি কারখানা ও ইটভাটার কালো ধোঁয়া, কার্বন-ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি, বনভূমি কমে যাওয়া, নলকূপ স্থাপন, ভূমির অপর্যাপ্ততা, ভূমিক্ষয়, অপরিকল্পিত চুলা ও জ্বালানি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ঘ। বৈশ্বক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে নিম্নাঞ্চল সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে করণীয়:

ক। পরিবেশ দূষণের প্রতিকার করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে গণমাধ্যমে বিপন্ন পরিবেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।

খ। গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

গ। কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে।

ঘ। বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। 

ঙ। পশুপাখির মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।

চ। ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে।

ছ। প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

জ। পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, জ্বালানি হিসেবে কাঠ কয়লা তেল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

ঝ। জনবসতিপূর্ণ স্থানে ইটভাটা বন্ধ করতে হবে।

ঞ। ইটভাটা অবশ্যই লোকালয় থেকে দূরবর্তী কোন স্থানে স্থাপন করতে হবে।

ট। শব্দদূষণের কারণে হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে।

ঠ। আইনের প্রয়োগ তো করতেই হবে, সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ যাতে না হয়, পানি বা শব্দদূষণ না হয় সে ব্যাপারে নিজেদের সতর্ক থাকতে হবে।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস :

জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে প্রতিবছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পর্ষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রথম সম্মেলনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘ ৫ জুনকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

উপসংহার: 

পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে। জীবন ধারায় আনতে হবে পরিবর্তন। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমাতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা আরো কমে যাবে। পরিবেশদূষণ এড়ানোর জন্য শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে নিজেদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব।

About মুহম্মদ জিয়াউর রহমান

Leave a Reply

Optimized by Optimole