ইয়াবাঃ পরিচিতি ও পরিণতি

‘Yaba’ ইয়াবা শব্দটি দুটি থাই শব্দ Yar ও bah থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো Crazy Medicine বা উত্তেজক ওষুধ। উত্তেজক মাদক Amphetamine এর অ্যানালগ Methamphetamine এর সংগে আরো কতিপয় যৌগ এর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ইয়াবা তৈরী করা হয়। রাসায়নিক চরিত্র, শক্তি, কার্যকারীতা ও প্রতিক্রিয়া বিচারে অ্যামফিটামিন, মেথামফিটামিন কিংবা কোকেনের চেয়েও ইয়াবা শক্তিশালী উচ্চমাত্রার উত্তেজক মাদকদ্রব্য। সাধারণত ৪ থেকে ৫ মি. মি. ব্যাস এবং আড়াই থেকে ৩ মি. মি. পুরু গোলাকৃতির ট্যাবলেট আকারে এটি তৈরী হয়। দেখতে অনেকটা ছোট আকারের ক্যান্ডির মতো। এর রং লালচে, কমলা, কিংবা সবুজাভ। এটি আঙুর, কমলা, ভ্যানিলা ইত্যাদি বিভিন্ন স্বাদ ও গন্ধের হয়ে থাকে। এ কারণে কোমলমতি শিশু কিশোর ও তরুণ তরুণীদের শক্তিদায়ক ক্যান্ডি বলে বিভ্রান্ত করে সহজে ইয়াবা ধরিয়ে দেওয়া যায়। এর গায়ে “WY”, “R”, “OK”, “SY” ইত্যাদি লোগো অঙ্কিত থাকে যা দেখে ব্যবহারকারীরা সহজে একে শনাক্ত করতে পারে। ইয়াবা পাউডার আকারেও তৈরি হয়।

ইয়াবা সেবন করলে ২ থেকে ৩ ঘন্টার মধ্যে এর স্নায়ু উত্তেজক ক্রিয়া শুরু হয়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টা স্থায়ী হয়। এ সময়ের মধ্যে ব্যবহারকারী শারীরিক ও মানসিকভাবে এমন এক জগতে অবস্থান করে যেখানে কোন ক্ষুধা, বেদনা, ক্লান্তি ও অবসাদ নেই। বরং ব্যবহারকারীর মধ্যে এক ধরনের অতিমানবিক শক্তি ভর করে। কিন্তু ১০-১২ ঘন্টা শেষে এর প্রভাব কেটে যাবার পর নতুন করে আবার এ মাদকটি গ্রহণ না করলে ব্যবহারকারীদের সোজা আকাশ থেকে পাতালে পতিত হবার অবস্থা হয়। মাদকের প্রভাব তাকে যে পরিমাণ গতি, ক্ষিপ্রতা, উচ্ছলতা, ও ক্ষমতা যোগায়, রক্তপ্রবাহ থেকে এর প্রভাব দূরীভূত হলে ব্যবহারকারী তার দ্বিগুণ পরিমাণ ভেঙ্গে পড়ে। তার মধ্যে নেমে আসে মৃত মানুষের নিস্তেজতা, নিঃস্বতা ‘ও অসাড়তা। সীমাহীন ক্লান্তি, অবসাদ, বিষাদ, অসহায়ত্ব ও নৈরাশ্য তাকে এক অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে দেয়। একে প্রত্যাহারজনিত প্রতিক্রিয়া বলা যায়। মেথামফিটামিনের প্রত্যাহারজনিত প্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও মারাত্মক, কখনও কখনও জীবন বিধ্বংসী। এর ব্যবহৃত ডোজ এর মাত্রা বেশি হলে প্রত্যাহারজনিত প্রতিক্রিয়া এত তীব্রতা লাভ করে যে এ অবস্থায় ব্যবহারকারী যে কোন অস্বাভাবিক ও অযাচিত ঘটনা ঘটাতে, এমন কি আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে।

ইয়াবার Flash বা উত্থান যত উঁচু, Fall বা পতন তার দ্বিগুণ নিচু। অতিরিক্ত উত্তেজক উপাদানমিশ্রিত ইয়াবা কোন সাধারণ বা দুর্বল মানুষের উপর প্রয়োগ করা হলে হার্টফেল বা ব্রেইন স্ট্রোকের সম্ভাবনা থেকে যায়। সম্প্রতি যে ইয়াবা তৈরী হচ্ছে এতে মেথামফিটামিনের উত্তেজনাকে balance করার জন্য তার সাথে ক্ষেত্র বিশেষে মরফিন বা হেরোইন জাতীয় নারকোটিক অ্যানালজেসিক, কিংবা অন্য কোন depressant drug মেশানো হয়। অধিক মুনাফার জন্য ইয়াবায় বেশ কয়েক ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য ভেজাল হিসেবে মেশানো হয়। এসব রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের Chemical salt, গৃহকর্মে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যবহার্য নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, ক্যামেরার ব্যাটারিতে ব্যবহার্য লিখিয়াম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব ভেজাল মেশানোর কারণে ইয়াবা অনেক সময় জীবনবিধ্বংসী হয়ে ওঠে। ইয়াবার মূল উপাদান মেথামফিটামিন মস্তিষ্কের মধ্যে অতি উচ্চমাত্রায় Dopamine নামক নিউরোট্র পমিটারের নিঃসরণ ঘটায়। এতে মস্তিষ্ক কোষের উত্তেজনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং Moodbody movement মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। এ কারণে পপ, ডিসকো, জ্যাজ, ব্যান্ড ইত্যাদি সংগীত ও নাচের আগে শিল্পীরা এগুলো ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে neuro- toxic effect তৈরী হয়ে মস্তিষ্ক কোষ ধ্বংস হয় যাতে Dopamine, serotonin ও অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটার থাকে। এভাবে মস্তিষ্ক কোষে Dopamine কমে গিয়ে Parkinson’s Diseases হতে পারে। ইয়াবা মস্তিষ্কের রক্তবাহী সূক্ষ্ম নালীগুলোকে ধ্বংস করে ব্রেইনস্ট্রোক ঘটাতে পারে। ইয়াবা কোকেনের চেয়েও মারাত্মক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী মাদক। এর ক্রিয়া কোকেনের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। এর কারণ হলো ইয়াবার মূল উপাদান মেথামফিটামিন কোকেনের চেয়ে ধীর গতিতে মেটাবলাইজ হয়। সাধারণত গৃহীত মাত্রা বা পরিমাণের উপর ইয়াবার প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে। ইয়াবার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ইউফোরিয়া বা চরম শিহরণমূলক আনন্দ, উচ্ছলতা প্রগলভতা, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, অরুচি ও বমিভাব, শরীরে গরম অনুভূতি, মুখের মধ্যে শুষ্কভাব, ঘাম, ছটফটানি, চপলতা, স্নায়ুর অসম্ভব জাগ্রত ও সংবেদনশীলতা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, শ্বাসপ্রশ্বাস বৃদ্ধি ইত্যাদি।

দীর্ঘদিন ও বেশিমাত্রায় ইয়াবা ব্যবহারের ফলে যেসব বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সেগুলো হলো : শরীরে অতিমাত্রায় শিহরণ ও কম্পন, দৃষ্টিবিভ্রম, নানা রকম মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতি, তীব্র হতভম্বতা, মানসিক বিভ্রম, স্থায়ী অনিদ্রা, মেজাজে অসহিষ্ণুতা, উন্মত্ততা, আক্রমণাত্মকভাব, মারমুখী ও ধ্বংসাত্মক আচরণ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, খিঁচুনি, অসহায়বোধ, স্মৃতিভ্রম ও স্মৃতিভ্রষ্টতা, হাইপার টেনশন, উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্কের রক্তবাহী ক্ষুদ্র নালীর ক্ষতি, ব্রেইনস্ট্রোক, ইত্যাদি। ইয়াবা মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট করে পারকিনসন’স এর মতো মাথার ও শরীরের কম্পনরোগ সৃষ্টি করতে পারে। ইয়াবাসহ মেথামফিটামিনের যে কোন উপযোগ বা উৎপাদিত পণ্য মধ্যম থেকে উচ্চমাত্রায় সেবন করলে প্রত্যাহারজনিত প্রতিক্রিয়াসহ মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক আসক্তি সৃষ্টি করে। সেবনের মাত্রা বেশি হলে হার্ট ফেল করে মৃত্যু হতে পারে। প্রথম ব্যবহার শুরু করার পরে হেরোইনের মতো ক্রমাগত এর মাত্রা বাড়ানোর দরকার হয়। সেবনের মাত্রা বেশী হলে ৩ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত কোন ঘুম আসে না।

নিয়মিত ইয়াবা ব্যবহারে ফুসফুস, লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়। দীর্ঘ দিন ইয়াবা ব্যবহার করার পরে speed bug অথবা crank bugs নামক hallucination তৈরী হয়। এতে ব্যবহারকারীর মনে হয় যেন সারা শরীরে চামড়ার নিচ দিয়ে ছারপোকা কিলবিল করে নড়ে বেড়াচ্ছে এবং ব্যবহারকারী এদের টিপে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে উন্মত্ত আচরণ করতে থাকে।

ইয়াবা ব্যবহার শেষে half life পার হওয়ার পর রক্ত প্রবাহে এর ক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে, কিংবা ব্যবহৃত মাত্রায় প্রয়োজনীয় ফলোদয় না হলে ব্যবহারকারীর মধ্যে চরম অবসাদ, হতাশা, বিষাল ও নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়। ব্যবহারকারী তখন যে কোন রকম অপ্রত্যাশিত আচরণ করতে পারে। এ অবস্থায় মানুষ খুন করাও বিচিত্র কিছু নয়। তীব্র প্রত্যাহারজনিত প্রতিক্রিয়ার সময় ব্যবহারকারীর হতাশা ও নৈরাশ্য এত মারাত্মক হতে পারে যা তাকে আত্মহত্যার নিকে নিয়ে যেতে পারে।

ইয়াবা ব্যবহারে যেসব উপযোগীতা বা মজা পাওয়া যায় বলে জনশ্রুতি বা লোকবিশ্বাস প্রচলিত, বিভিন্ন গবেষণায় এর কার্যকারিতা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মেথামফিটামিন বা ইয়াবা ব্যবহারে সাময়িকভাবে কয়েক দিনের জন্য অরুচি এনে বা ক্ষুধা নষ্ট করে হয়তো শরীরের মেদ বা স্থূলতা কিছুটা কমানো যায়। কিন্তু এ অবস্থা ক্রমাগত চলতে থাকলে এতে শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ ও অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় জৈব রাসায়নিক উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে মারাত্মক অপুষ্টি সৃষ্টি হয়ে নানা রোগ ব্যাধির বিস্তার এবং জৈব রসায়ণ প্রক্রিয়ার জটিলতাসহ শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালান্স নষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ইয়াবা ব্যবহারের ফলে মানবদেহের সামগ্রিক বৃদ্ধি ৭০% থেকে ৮০% বাধাগ্রস্ত হয় এবং দেহের আকৃতি ও উচ্চতা হ্রাস পেতে থাকে।

ঘুম তাড়ানের জন্য যার ইয়াবা বা মেথামফিটামিন ব্যবহার করে, তারা পরবর্তী সময়ে নারকলেপসি নামক রোগের শিকার হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ছেড়ে দেওয়ার পরও একটানা ৮/১০ দিন ঘুমানো যায় না। আবার ক্ষেত্র বিশেষে বিপরীত হয়। দেখা যায় ব্যবহারকারী একটানা ৪/৫ দিন পক্ষাঘাতগ্রস্থ অবস্থার মত হয়ে মৃতবৎ পড়ে থেকে শুধুই ঘুমাচ্ছে। যে সব ছাত্র পরীক্ষার পূর্বে রাত জাগার জন্য মেথাফিটামিন ব্যবহার করেছে দেখা গেছে তাদের সবাই পরদিন পরীক্ষায় খারাপ করেছে। উচ্চমাত্রায় মেথাফিটামিন ব্যবহার করার ফলে মারাত্মক Delusion বা মতিভ্রম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় যে কোন রকম দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে জীবননাশ হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। একটা জনশ্রুতি ও প্রচলিত লোক বিশ্বাস আছে যে, মেথামফিটামিন, ইয়াবা বা এ জাতীয় উত্তেজক এ্যাথলেটদের পারফরমেন্স বৃদ্ধি করে। ঘটনা কিছুটা সত্য। এক্ষেত্রে পারফরমেন্স বৃদ্ধির বিষয়টি ক্ষণস্থায়ী, সামরিক এবং এর পরিমাণও খুবই কম। ইয়াবা বার বার

ব্যবহার করলে শরীরের নিজস্ব Stamina বা ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে ঐ এ্যাথলেটের ক্যারিয়ার চিরজীবনের জন্য শেষ হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের শহর জনপদের ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে ইদানিং ইয়াবা আসক্তির যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা সমগ্র জাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিতবাহী। ইয়াবা কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রাণশক্তি ও মেধাকে ধ্বংস করছে না, ইয়াবার কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপসংস্কৃতি ও অপরাধের বিস্তার ঘটছে। সুতরাং ইয়াবার সর্বগ্রাসী গতিকে রুখতে হলে সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। ইয়াবার বিরুদ্ধে দুর্বার সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হবে।

ইয়াবা সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিরোধ শিক্ষা, গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগে যোগাযোগ করুন।

About মুহম্মদ জিয়াউর রহমান

Check Also

ক্যাডেট পদোন্নতি পরীক্ষার দরকারী প্রশ্ন ও উত্তর-০২

প্রশ্নঃ দুর্যোগ কাকে বলে? দুর্যোগের প্রকারভেদ কয়টি ও কি কি?  উত্তরঃ যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বিপন্ন …

Leave a Reply

Optimized by Optimole